১৯ শতকে অফুরান কয়লা মজুদকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্যের মতো ছোট্ট দেশ শিল্প বিপ্লবের সূচনা করে। পৃথিবীজুড়ে গড়ে তোলে অসংখ্য উপনিবেশ। সেই ব্রিটেনকে আবার শক্তি ও প্রভাবে ছাড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। তার পেছনেও ছিল আদিগন্ত চাষযোগ্য জমি, বিপুল জ্বালানি তেল মজুদসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রই হয়ে ওঠে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
চীনের উত্থান প্রসঙ্গেও একই কথা বলা যায়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে স্বাগত জানানোর পুঁজিবাদি সংস্কার এবং বিশাল জনসংখ্যার সুবাদেই ১৯৭০ এর দশকের শুরু থেকে ২০০০ এর দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত বিশ্বসেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে বেইজিং।
দ্রুত ফুরিয়ে আসছে ক্ষমতাধর চীনের সুপেয় পানির সম্পদ। এই পরিবর্তন খুব সম্ভবত দেশটির ভেতরে বাইরে সবখানেই সংঘাত আর বিরোধের জন্ম দিতে চলেছে। ভূমি, সুপেয় পানি ও অন্যান্য কাঁচামালে চীন ছিল স্বনির্ভর। এই সম্পদকে সস্তা শ্রমের সাহায্যে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কাজে লাগায় দেশটি। কর্মীর প্রাচুর্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকেও গতিশীল করে। ফলে আজ দেশটি ‘বিশ্বের কারখানা’ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু, সময়ের সাথে সাথেই চীনের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য অতীতের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গিয়ে চীন যেভাবে তার বহু সম্পদকে নিঃশেষিত করে ফেলেছে, তারই ধারাবাহিকতায় এক দশক আগে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃষিপণ্য আমদানিকারকে পরিণত হয়। এর প্রধান কারণ, অতি-ব্যবহার ও দূষণে সংকুচিত হচ্ছে দেশটির চাষযোগ্য জমি। প্রচণ্ড গতির উন্নয়নের বদৌলতে দেশটি আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ জ্বালানি আমদানিকারক। প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা সম্পূর্ণরূপে জ্বালানি রপ্তানিকারকে পরিণত হলেও নিজ চাহিদার তিন-চতুর্থাংশ তেল বিদেশ থেকেই কিনতে হচ্ছে চীনকে।
চীনের অস্তিত্ব কতটা হুমকিতে?
চীনের সুপেয় পানিভাণ্ডারের অবস্থা আরো উদ্বেগজনক। গবেষণা থেকে জানা যায়, চীনে বিশ্বের ২০ শতাংশ মানুষের বসবাস, সে তুলনায় সুপেয় পানির মজুদ মাত্র ৭ শতাংশ। দেশটির উত্তরে এই সংকট অতি-প্রবল। সেখানে অনেক অঞ্চলে মিঠা পানির সংকট মধ্যপ্রাচ্যের অতি-উষ্ণ কিছু এলাকার চেয়েও ভয়াবহ।
শুকিয়ে গেছে হাজার হাজার নদী-উপনদী। বাকি পানিপ্রবাহকে দূষিত করেছে শিল্প ও আবাসিক এলাকার বর্জ্য। কিছু প্রক্ষেপণ অনুসারে, চীনের ৮০-৯০ শতাংশ ভুগর্ভস্থ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ নদীর পানি এমনকি শিল্প কারখানা বা কৃষিকাজেও ব্যবহার উপযোগী নয়।
স্বাদু পানির এ সংকট সমাধান অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে অপেক্ষাকৃত আর্দ্র অঞ্চল থেকে উত্তরের ক্ষরাপ্রবণ অঞ্চলে নদীর গতিপথ বদলে পানিপ্রবাহ আনতে হচ্ছে দেশটিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি সংকটের কারণে প্রতিবছর দেশটি ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
পানি সংকট ও অটেকসই চাষাবাদের কারণে বছর না ঘুরতেই শুস্ক মরুতে রূপ নিচ্ছে বিশাল অংশের জমি। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাধে পানির অভাবে বিদ্যুৎ সংকটের ঘটনাও এখন চীনজুড়ে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানির অপচয় কমাতে রেশনিং ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। কিন্তু তা সমস্যা সমাধানে মোটেও যথেষ্ট নয়। চলতি মাসে চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, পার্ল নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ার পরও দুটি প্রধান শহর গুয়াংঝু এবং শেনঝেন আগামী বছর পর্যন্ত খরার মধ্যে থাকবে।
অস্থিতিশীল হবে গোটা এশিয়া
এ ঘটনার অর্থনৈতিক ও রাজরণে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে আরও ব্যয় করতে হচ্ছে। আর এটাই তো বেইজিংয়ের একমাত্র সমস্যা নয়। পড়তি তরুণ ও কর্মক্ষম জনসংখ্যা, ক্রমশ উত্তেজক বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনৈতিক অনেক সংস্কার বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় এই ব্যয় নতুন মাত্রা যোগ করছে। প্রাকৃতিক সম্পদের বন্টন ঘিরে আগামী দিনগুলোতে চীনা সমাজের সামাজিক ঐক্যও পরীক্ষার মুখে পড়বে।
২০০৫ সালে সত্যিই বলেছিলেন প্রিমিয়ার ওয়েন জিয়াবাও। মিঠা পানির সংকট “সমগ্র চীনা জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে” বলে উল্লেখ করেন তিনি। সম্প্রতি দেশটির একজন পানিসম্পদমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে, “চীনকে প্রতি ফোটা পানির জন্য লড়াই করতে হবে, নাহয় মরতে হবে।” এখানে অতি-রঞ্জনের কিছু নেই। এ সম্পদের সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা হাত ধরেই চলে।
অভ্যন্তরীণ অশান্তির সাথে সাথেই দেখা দেবে বৈদেশিক উত্তেজনা। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, চীনা সমাজতন্ত্রী দল অভ্যন্তরীণভাবে অনিরাপদ বোধ করলে আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। পানি সংকট প্রতিবেশীদের সাথেও ভূ-রাজনৈতিক বিরোধের জন্ম দেবে।
চীনের সিংহভাগ মিঠা পানির উৎস- তিব্বত। ১৯৪৯ সালে সামরিক শক্তির বলে এ অঞ্চল দখল করে নেয় কমিউনিস্টরা। চীন দীর্ঘদিন ধরেই নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশগুলোকে বঞ্চিত করে আসছে।
যেমন মেকং নদীতে সিরিজ বাঁধ নির্মাণ করে থাইল্যান্ড ও লাওসের মতো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে খরা ও ভয়াবহ বন্যার মুখে ফেলেছে বেইজিং। জিনজিয়াং প্রদেশে নদীর দিকপরিবর্তন নিম্ন-অববাহিকার মধ্য এশীয় দেশগুলোর দুর্দশার কারণ হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় উত্তেজনা ঘনীভূত হচ্ছে হিমালয়ে। এখানে নিজেদের তিব্বত অংশে বাঁধ নির্মাণ করতে চায় বেইজিং। প্রধান প্রধান নদীর ওপর নির্মিত এসব বাঁধ প্রতিবেশী ভারতে যাওয়ার আগেই নদীস্রোতকে আটকাবে। ফলে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই।
ভারতীয় ভূ-কৌশল বিশেষজ্ঞ ব্রহ্ম চেলানী মনে করেন, “দক্ষিণ চীন সাগর ও হিমালয়ে সীমানা বিস্তারের সাথে সাথেই অতি-গোপনে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর জলপ্রবাহ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন।”
সোজা কথায় চীন যতই তৃষ্ণার্ত হবে ভূ-রাজনীতি ততোই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। যার পরিণতি এশিয়ার সিংহভাগ জনতাকে দুর্ভোগে ফেলবে নিঃসন্দেহে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫৮
আপনার মতামত জানানঃ