আমেরিকা আবিষ্কারের পর জমি ভাগাভাগি নিয়ে আঠারো শতকের দিকে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বেধে যায়। কুইন অ্যানি’স নামের সেই যুদ্ধে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্ত হয় স্পেন। তারা পুরো আমেরিকা জুড়ে অবিচারে গণহত্যা চালায়। আর সঙ্গে টন টন সোনা লুট করে। এই যুদ্ধে ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর একজন মারকুটে নাবিক ছিলেন, এডওয়ার্ড টিচ। যিনি পরবর্তীকালে ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’ নামে পরিচিত হন।
১৭১৬ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্ল্যাকবিয়ার্ড যোগ দেয় তখনকার আরেক কুখ্যাত জলদস্যু ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের দলে। ধীরে ধীরে ব্ল্যাকবিয়ার্ড সেই জলদস্যু দলটিকে নিজের কবজায় করে ফেলে। আর তার জাহাজের নাম ছিল ‘কুইন অ্যানি’স রিভেঞ্জ’।
তিনি তার জাহাজে প্রায় ৪০টার মতো কামান বসান। আর এই জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে তার নৃশংস চালিয়ে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে ক্যারিবীয় ও আটলান্টিক সমুদ্রের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। ঘনকালো দাড়ির জন্য এডওয়ার্ড টিচের নাম হয় ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’। তার ভয়ে সমুদ্রে যাওয়া এক প্রকার দুষ্কর হয়ে পড়ে।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড প্রচন্ড ধূর্ত একজন জলদস্যু ছিলেন। সে জানতো সে দেখতে ভয়ানক। তাই অন্য জাহাজে ডাকাতি করার সময় ইচ্ছে করেই টুপির দুই দিকে দুইটি রং মশাল জ্বালিয়ে রাখতো। যাতে বিপদগ্রস্থ জাহাজের নাবিকেরা ভয় পায়। ব্ল্যাকবিয়ার্ড ইচ্ছে করে সব জায়গায় একটা ভয়ংকর খুনির ছবি গড়ে তুলেছিল তার নিষ্ঠুর আর বেপরোয়া জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। ফলে লুটপাটের সময় ঝামেলা কম হতো।
ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজে প্রায় ৩০০ জনের মতো দস্যু একসঙ্গে থাকতে পারতো। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের দলের দস্যুরা ছিল কঠোর পরিশ্রমী এবং একইসঙ্গে ভীষণ মাত্রার মাতাল। মাঝে মাঝে তাদের উদ্যাম আচরণ এতটাই লাগামছাড়া হয়ে উঠতো যে তা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হতো ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে।
একবার ব্ল্যাকবিয়ার্ড তার ফার্স্ট মেট ইসরায়েল হ্যান্ডসের সঙ্গে বসে মদ্যপান করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে সামনে থাকা মোমবাতিটি নিভিয়ে দিয়ে বন্দুক বের করে হ্যান্ডসের হাঁটুতে গুলি করেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের এমন কাজে রীতিমতো অবাক হ্যান্ডস ব্যথায় কাতর হয়ে গুলি করার কারণ জানতে চাইলো। কারণ সে তো কোনো দোষ করেনি। জবাবে ব্ল্যাকবিয়ার্ড বলে, ‘যদি আমি যখন তখন ক্রু মেম্বারকে গুলি না করি, তাহলে তারা ভুলে যাবে যে আমি কে!’
এমন সময় হঠাৎ করে সামনে থাকা মোমবাতিটি নিভিয়ে দিয়ে বন্দুক বের করে হ্যান্ডসের হাঁটুতে গুলি করেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড
এমন সময় হঠাৎ করে সামনে থাকা মোমবাতিটি নিভিয়ে দিয়ে বন্দুক বের করে হ্যান্ডসের হাঁটুতে গুলি করেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড
নারী মহলেও বেশ ভালোই জনপ্রিয় ছিল ব্ল্যাকবিয়ার্ড। অত্যন্ত তার বিয়ের সংখ্যা এই ব্যাপারেই সাক্ষ্য দেয়। জীবদ্দশায় মোট ১৪টি বিয়ে করেছিলেন তিনি। যদি কোনো নারীকে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ভালো লেগে যেতো আর তাকে তিনি বিয়ে করতে চাইতেন, তাহলে তার সঙ্গে এমন আচরণ করতেন যেন সেই নারী তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।
কুইন অ্যানি’স রিভেঞ্জে কামানের সংখ্যা ছিল মোট ৪০টি। তবে এসব কামানে গোলার পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করতেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। আসলে তিনি যখন সদলবলে কোনো জাহাজের উপর হামলা চালাতেন তখন সেই জাহাজ ডুবিয়ে দেয়ার পরিবর্তে তাদের লুটপাট চালানোই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। তাই তিনি এমন কিছু জিনিস বেঁছে নিয়েছিলেন যেগুলো গোলার মতোই ভয়ানক। কিন্তু অতোটা বিধংসী নয়।
এই জলদস্যু জাহাজে ব্যাগভর্তি কাঁচের টুকরা আর পেরেক থাকতো। কোনো জাহাজে লক্ষ্য করে তিনি যখন এসব নিক্ষেপ করতেন তখন জাহাজটির ক্ষতির চেয়ে বেশি ক্ষতি হতো সেই জাহাজে থাকা মানুষগুলোর। যখন ব্ল্যাকবিয়ার্ড সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঐ জাহাজে যেতেন, ততক্ষণে অনেকেরই দফারফা শেষ হয়ে যেতো। অবশ্য সবসময় তিনি কেবল এসব নিক্ষেপ করতেন, তা নয়।
যখন মেজাজ অতিরিক্ত মাত্রায় চলে যেতো তখন একসঙ্গে গোলা আর কাঁচের টুকরো দুইটিই নিক্ষেপ করা হতো। তবে ব্ল্যাকবিয়ার্ড এতো দস্যুতা করে ঘুরে বেড়াবে আর শক্তিশালী ব্রিটিশ নৌবাহিনী চুপ করে সেটা দেখবে। তা তো হতে পারে না। তারাও একেবারে কোমর বেঁধে লেগেছিল ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে ধরতে।
তবে এই সময়টা ছিল জলদস্যুদের জন্য স্বর্ণযুগ। তারা এই সময় এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে অনেক সময় সামরিক বাহিনী বাধ্য হয়েছিল ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মতো দস্যুদের পিছনে ছোটা বাদ দিতে।
তখনকার দিনে এমন এক নিয়ম ছিল যে যদি কোনো জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো দিন দস্যুতায় না জড়ানোর ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে তাকে পুরোপুরিভাবে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এ কথা সত্যি যে, ব্ল্যাকবিয়ার্ডও সেই ক্ষমতা প্রাপ্তদের দলে একবার নাম লিখেয়েছিলেন। প্রথমেই ব্ল্যাকবিয়ার্ড তার বন্ধু স্টীড বনেটকে রাজি করান যেন বনেট আত্মসমর্পণ করে ক্ষমাপ্রাপ্তদের দলে যোগ দেয়। এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনায় বনেট যখন মশগুল তখন ব্ল্যাকবিয়ার্ডের লোকেরা বনেটের জাহাজে হামলা চালায়।
তাকে এবং জাহাজের অন্য সবাইকে চোখ বেঁধে এক নির্জন দ্বীপে ফেলে আসে তারা। কেড়ে নেয় বনেটের সব সম্পদ। বনেট যখন ফিরে আসেন ততক্ষণে তার সবকিছুই চলে গেছে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের বাহিনীর হাতে। ব্ল্যাকবিয়ার্ডও কিছুদিনের মধ্যে দস্যুতা না করবে জানিয়ে আত্মসমর্পণ করে সরকারের কাছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ক্ষমা পেয়ে গেলেও খুব বেশিদিন এভাবে হাত-পা গুটিয়ে থাকতে ভালো লাগেনি এই জলদস্যুর।
তাই কিছুদিন পরে আবারো তাকে দেখা গেল বাহিনী নিয়ে সাগরের বুকে ক্রীতদাসবাহী জাহাজ ও অন্যান্য সম্পদশালী জাহাজগুলোতে লুটপাট করে বেড়াতে। এবার আর সহ্য হলো না সামরিক বাহিনীর। লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেনার্ড দুইটি জাহাজ আর ৬০ জন সেনা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে হত্যা করার জন্য। তিনি তাদেরকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যেন দূর থেকে দেখে মনে হয় সেই জাহাজটি পরিত্যক্ত এবং ব্ল্যাকবিয়ার্ড তাতে আসতে আগ্রহী হয়।
সত্যি সত্যি সমুদ্রের ত্রাস ব্ল্যাকবিয়ার্ড সেদিন লেফটেন্যান্ট মেনার্ডের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। অরক্ষিত অবস্থায় তিনি জাহাজের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন তখনই হঠাৎ দস্যুদের বাহিনীর উপর চড়াও হয় মেনার্ডের সেনারা। এমন আক্রমণ হতভম্ব হয়ে যায় জলদস্যুরা। ক্ষেপে গিয়ে সরাসরি আক্রমণ করে বসে মেনার্ডের উপর।
মেনার্ডও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। তিনি গুলি করে বসেন সরাসরি ব্ল্যাকবিয়ার্ডের বুকে। এতে যেন হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। আঘাতের কারণে অগ্নিশর্মা হয়ে মেনার্ডের উপর তীব্রভাবে হামলা চালালেন ব্ল্যাকবিয়ার্ড। এরপর এক ভয়ংকর যুদ্ধে পরাজিত হয় ৩৮ বছর বয়সী ব্ল্যাকবিয়ার্ড। লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেনার্ড নিজের হাতে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মাথা কেটে সেটা জাহাজের সামনে ঝুলিয়ে দেশে ফেরেন।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড মারা গেলেও সে যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পত্তি লুট করেছিল, তার হদীস কেউ পায়নি। মাত্র দুই বছরের জলদস্যু জীবনে সে যে পরিমাণ ত্রাস সরিয়েছিল তার মৃত্যুর পর অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে সে মারা গিয়েছেন। ব্ল্যাকবিয়ার্ড মারা যাওয়ার আগে স্বীকার করেছিলেন সে তার লুট করা সম্পত্তি লুকিয়ে রেখে গেছে।
প্রায় ৩০০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু সে গুপ্তধনের খোঁজ এখনো চলছে। ১৯৯৬ সালে নর্থ কারোলিনার বিউপোর্ট সমুদ্রের গর্ভে কুইন অ্যানি’স রিভেঞ্জ জাহাজটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে সম্পত্তির একটা কানাকড়িও পাওয়া যায়নি। গবেষকদের ধারণা, ব্ল্যাকবিয়ার্ড তার গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোর কোনো এক গুহায়।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১২
আপনার মতামত জানানঃ