ইয়েমেনের এক মানবাধিকারকর্মীকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন সৌদি আরবের একটি আদালত। ধর্মত্যাগ করে নাস্তিকতার প্রচার চালানোর অভিযোগ এনে সোমবার দেশটির একটি আদালত এই রায় ঘোষণা করেছেন বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সৌদি আরবে যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংস্কারযজ্ঞ চলছে, তখন ব্লাসফেমিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, আলী আবু লুহুম (৩৮) নামের ওই ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে দু’টি ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে কমেন্ট করেছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল। আদালতের বিচারকরা বলেছেন, ওই দু’টি অ্যাকাউন্ট যে ফোন নম্বর দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল তা আবু লুহুমের।
সাক্ষী ছাড়াই অভিযুক্তদের এই বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। সংস্থাটি বলেছে, আদালত দেখতে পেয়েছেন, ওই দু’টি অ্যাকাউন্ট থেকে যেসব টুইট করা হয়েছিল সেগুলোতে ধর্মত্যাগ, অবিশ্বাস এবং নাস্তিকতার প্রচার রয়েছে।
আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, আবু লুহুমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকারের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনশৃঙ্খলা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জনসাধারণের নৈতিকতা নষ্ট করতে পারে এমন বিষয়বস্তু ছিল।
আবু লুহুমকে ‘নাস্তিকতা প্রচারের’ দায়ে দোষী সাব্যস্ত এবং ‘ধর্মত্যাগের’ জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। তবে তাকে নির্দিষ্ট কোন মন্তব্যের কারণে অভিযুক্ত করা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি আদালত।
ইয়েমেনের এই নাগরিকের কারাদণ্ডের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রিয়াদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। আবু লুহুমকে ইয়েমেন সীমান্তের কাছে সৌদি আরবের নাজরানের একটি কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে।
জি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছাড়ার পর থেকে ভিন্নমতামবলম্বীদের ওপর দমনপীড়নের অভিযোগ উঠেছে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে। একইসাথে গত বছরের তুলনায় হঠাৎ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে সৌদি আরব। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ইতোমধ্যে ৪০ জনের মৃত্যু কার্যকর করেছে দেশটি। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে।
সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানায়, গত বছর বিশ্বের ধনীদেশগুলোর ফোরাম জি-টোয়েন্টির নেতৃত্বে ছিল সৌদি আরব। সেসময় অপ্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুদণ্ড বাতিল এবং জনসমক্ষে বেত্রাঘাত নিষিদ্ধসহ কিছু পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছিল সৌদি সরকার।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জি-টোয়েন্টি প্রেসিডেন্সি ছাড়ার পর চলতি বছর আবার সেদেশে মানবাধিকারকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন ও গত ছয় মাসে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের হার বেড়ে গেছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সৌদি আরবে অন্তত ৪০ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে৷ এর আগে সৌদি হিউম্যান রাইটস কমিশন নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছিল, ২০২০ সালে ২৭টি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল যা ছিল ২০১৯ সালের তুলনায় ৮৫ শতাংশ কম।
সৌদি আরবে যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংস্কারযজ্ঞ চলছে, তখন ব্লাসফেমিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করতে দেশটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সৌদি আরব। গত বছর পুরোটা সময় যতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল রিয়াদ, এই সংখ্যাটা তার চেয়ে অনেক বেশি।
এর আগে ২০১৯ সালে ১৮৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল সৌদি আরব। সৌদি সরকারের মদতপুষ্ট মানবাধিকার কমিশন জানুয়ারিতে জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরিমাণ ৮৫ শতাংশ কমিয়েছে রিয়াদ। ওই বছর দেশটিতে ২৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
২০২০ সালে প্রথমবারের মতো জি২০ সম্মেলনের নেতৃত্ব দিয়েছে সৌদি। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ওই বছর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে জি২০ সম্মেলনের পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হার আবারও বেড়ে গেছে। ওই বছরের ডিসেম্বরেই ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
চলতি বছরের জুনে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অথচ তিনি ১৮ বছরের কম বয়সে অপরাধ করেছিলেন। দেশটিতে এমন ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। যদিও সৌদির দাবি, কিশোর বয়সে করা অপরাধের জন্য তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছে না।
গবেষকরা হিসেব করে দেখেছেন চলতি বছর রিয়াদের বিশেষ অপরাধ আদালত (এসসিসি) অন্তত ১৩ মানবাধিকার কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে এসব লোকজনকে মাসের পর মাস বিনা বিচারে কারাবন্দি করে রাখা হয় এবং তাদেরকে উকিলের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেয়া হয় না।
অ্যামনেস্টির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সৌদি সরকারের সমালোচনা, মানবাধিকার, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন এমন অন্তত ৩৯ জন বর্তমানে কারাভোগ করছেন। শুধুমাত্র সৌদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করে টুইট করায় এক মানবাধিকার কর্মীকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপপরিচালক লীন মালুফ বলেন, গত নভেম্বরে জি-টোয়েন্টি সম্মেলন আয়োজনের সময় সাময়িকভাবে বিরুদ্ধমত দমন বন্ধ রাখার অর্থ হচ্ছে দেশটিতে নিয়মনীতি সংস্কার চলছে বলে যে ধারণা তৈরি করা হয়েছিল তা আসলে প্রচারণা ছাড়া কিছুই নয়।
তিনি জানান যে, শুধুমাত্র সৌদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করে টুইট করায় এক মানবাধিকার কর্মীকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মাঝেমধ্যে কিছু কিছু অধিকারকর্মীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেও তাদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর মধ্যে প্রখ্যাত নারী অ্যাকটিভিস্ট লুজাইন আল-হাথলুলের ওপর পাঁচ বছরের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৪
আপনার মতামত জানানঃ