সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। সংবাদ প্রকাশের কারণে চলতি বছর বিশ্বে ৪৬ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশে কারাবন্দী আছেন ৪৮৮ জন।
২০২১ সালের চিত্র তুলে ধরে আজ বৃহস্পতিবার এসব তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক এই সংগঠনটি ২৫ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার-হত্যার ঘটনা নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। সংগঠনটি বলছে, গত ২৫ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। তবে সবচেয়ে কম সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এ বছর। মধ্যপ্রাচ্যে তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকায় সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা কমেছে বলে জানিয়েছে তারা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা এই সংগঠনটি আরও বলেছে, গত বছরের তুলনায় সাংবাদিকদের নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। যে দেশ ও এলাকাগুলোয় এমন ঘটনা বেড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে হংকং, মিয়ানমার ও বেলারুশ।
আরএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলতি বছরে যে পরিমাণ নারী সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, সেই পরিমাণ নারী সাংবাদিকে পূর্ববর্তী কোনো বছরে আটক হননি। চলতি বছর নারী সাংবাদিক আটক হয়েছেন ৬০ জন, যা ২০২০ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি।
সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন চীনে। দেশটিতে ১২৭ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই দেশটিতে সাংবাদিক বেশি গ্রেপ্তার হওয়ার কারণ, দেশটির আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ে বিতর্কিত জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ। গ্রেপ্তারের ঘটনায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার। দেশটিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫৩ জন সাংবাদিক। এ ছাড়া ভিয়েতনামে ৪৩, বেলারুশে ৩২ ও সৌদি আরবে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩১ জন।
আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সিরিয়া, ইরান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে সহিংসতা কমতে থাকায় ২০১৬ সালের পর থেকে সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা কমছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৪৬ সাংবাদিকের মধ্যে অধিকাংশকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শতকরা হিসেবে এই সংখ্যা ৬৫।
আরএসএফ বলছে, বিশ্বজুড়ে ৬৫ জন সাংবাদিককে অপহরণ করা হয়েছে চলতি বছর। এর মধ্যে ৬৪ জনই অপহৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশে। সিরিয়ায় অপহৃত হয়েছেন ৪৪ জন। ইরাকে ১১ ও ইয়েমেনে অপহৃত হয়েছেন ৯ জন। আর একজন সাংবাদিক অপহৃত হয়েছেন ফ্রান্সে।
চলতি বছরে যে পরিমাণ নারী সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, সেই পরিমাণ নারী সাংবাদিকে পূর্ববর্তী কোনো বছরে আটক হননি। চলতি বছর নারী সাংবাদিক আটক হয়েছেন ৬০ জন, যা ২০২০ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি।
এর আগে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার অলাভজনক বৈশ্বিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) নতুন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল সংবাদ প্রকাশের কারণে চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে কমপক্ষে ২৪ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া আরও ১৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তবে সেক্ষেত্রে এটি নিশ্চিত নয় যে—সংবাদ প্রকাশের কারণেই তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন কি না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের ওপর হামলা নিয়ে বৃহস্পতিবার সিপিজে’র এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক এই সংস্থাটি বলছে, ২০২১ সালে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী কারাবন্দি হয়েছেন ২৯৩ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক আটকের ঘটনা ঘটেছে চীনে। অন্যদিকে ২০২০ সালে সারা বিশ্বে কারাবন্দি সাংবাদিকের সংখ্যা ছিল ২৮০ জন।
সংস্থাটি বলছে, সাংবাদিকদের জেলে পাঠানোর পেছনে দেশ ভেদে কারণগুলো ছিল ভিন্ন। তবে সাংবাদিক আটকের বেশিরভাগ কারণই ছিল রাজনৈতিক এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা।
এছাড়া সংবাদ প্রকাশ বা পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে চলতি বছর বিশ্বব্যাপী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৪ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের চিত্র সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী এবং মেক্সিকান সাংবাদিক গুস্তাভো সানচেজ ক্যাবরেরাও রয়েছেন। পেশাগত দায়িত্বপালনের সময় গত জুলাই মাসে আফগানিস্তানে দানিশ সিদ্দিকীকে এবং জুন মাসে মেক্সিকোতে গুস্তাভো সানচেজকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এদিকে রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডার (আরএসএফ) অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাংবাদিক নিপীড়ক’। আর করোনা মহামারিকালে বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্রের বিধিনিষেধ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। চীনে বর্তমানে অন্তত ১২৭ জন সাংবাদিক কারাগারে বন্দী আছেন। চীন বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘নিপীড়নের ভয়ঙ্কর কর্মসূচি’ চালাচ্ছে। যদিও চীন সাংবাদিক ও নাগরিক সাংবাদিকদের এই গ্রেপ্তারের স্বপক্ষে অজুহাত দেয় এই বলে যে, গ্রেপ্তারকৃতরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে উসকানি দিয়েছে।
কোন কোন কৌশলে সাংবাদিকদের ওপর দেশটি নিপীড়ন চালায় তাও প্রতিবেদনে তালিকা করে দেখানো হয়েছে। যেমন—সাংবাদিকদের আক্রমণ করতে বিদেশে থাকা কূটনৈতিক মিশনকে ব্যবহার করা, সংবাদমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরা, বিভিন্ন বিষয়ের উপর নজরদারি আরোপ, জোরপূর্বক স্থানীয় সাংবাদিকদের কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ পড়ানো, মুঠোফোনে প্রোপাগান্ডা অ্যাপ ডাউনলোড করানো এবং সাংবাদিকদের বহিষ্কার বা ভয় দেখানো।
আরএসএফ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স-২০২১ এ চীনকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৭ নম্বরে রেখেছে। যা উত্তর কোরিয়া থেকে মাত্র দুই ধাপ উপরে।
সাংবাদিক হত্যায় দায়মুক্তির প্রবণতা খুব বেশি। ইউনেসকোর তথ্য মতে, এ ধরনের ১০টি ঘটনার প্রায় নয়টিতেই কারও সাজা হয় না। সংঘাতের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি সংঘাত ছাড়াও সংবাদকর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব সামগ্রিকভাবে সমাজের ওপর পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায় যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া, অপহরণ, নির্যাতন, ডিজিটাল ও অন্যান্য মাধ্যমে গুজব রটানোসহ নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অনলাইন সহিংসতার মাত্রা বেশি বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাংবাদিকরা আরও অগুনিত হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। যেমন—অপহরণ, নির্যাতন ও গুম থেকে শুরু করে গুজব রটানো ও হয়রানি, বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে, অনেক ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নারী সাংবাদিকরা বিশেষত অনলাইন সহিংসতার ঝুঁকিতে বেশি।
তিনি বলেন, সমাজের ওপর সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায়, যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৮
আপনার মতামত জানানঃ