মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে প্রথম বারের মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় বন্দরনগরী জেদ্দায় এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে আরব নিউজ।
এই উৎসব ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয় মার্কিন নির্মাতা জো রাইট পরিচালিত ‘সাইরানো’।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তারকা অভিনেতা/অভিনেত্রী, পরিচালক, চিত্রকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীরা এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এই উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আল-তুর্ক উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এই মুহূর্তটির জন্য আমাদেরকে অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।’
জানা যায়, ৬৭টি দেশের ৩৪ ভাষায় নির্মিত ১৩৮টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে এই উৎসবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ২৫টি ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। এছাড়াও রয়েছে ৪৮টি আরব প্রিমিয়ার এবং ১৭টি উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রিমিয়ার।
সৌদির এই পরিবর্তনের কারণ কী?
৩৫ বছর ধরে সৌদি আরবে চলচ্চিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১৮ সালে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তারও ৩ বছর পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করার পর সৌদি আরবে দ্রুতই সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, বিংশ শতাব্দীতে আল-সৌদ পরিবারের ক্ষমতার উৎস ছিল দুটি। একটি হচ্ছে তাদের তেল সম্পদ, আর দ্বিতীয়টি হলো রক্ষণশীল ইসলাম ধর্মীয় নেতাদের সাথে একটা অনানুষ্ঠানিক ‘চুক্তি’।
কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। কারণ একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা যাচ্ছে যে তেলের অর্থ এখন আর সরকারি ব্যয় মেটানো বা কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয় এবং সৌদি রাজপরিবারের নতুন নেতাদের ওপর ধর্মীয় নেতাদের প্রভাবও কমে গেছে।
২০১৮ সালে যখন সৌদিতে সিনেমার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়, দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২০ লাখ এবং এর বেশিরভাগই তরুণ যাদের বয়েস ৩০-এর নিচে। তাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করার জন্যই বাদশাহ সালমান নতুন যুবরাজ করেন মোহাম্মদ বিন সালমানকে; যিনি মূলত এখন সৌদি আরবের ভবিষ্যত গতিপথ তৈরির প্রধান সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন।
মোহাম্মদ বিন সালমান কার্যত একটা নতুন মডেল দিয়েছেন সৌদি আরবের জন্য। আর তা হলো বেশি করে কাজ করো, জীবনের আনন্দ উপভোগ করো; কিন্তু সৌদি সিস্টেমের সমালোচনা করো না। এভাবেই তিনি নাগরিকদের আরো বেশি রাজনৈতিক অধিকার দেবার যে চাপ তা মোকাবিলা করতে চাইছেন।
অনেকটা প্রতিবেশী দুবাইয়ের মতো, তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাড়াচ্ছেন না। তার পরিবর্তে সামাজিক স্বাধীনতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সিনেমা হল খোলা বা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তারই অংশ। কিন্তু একটা গুরুতর প্রশ্ন হলো সৌদিরা কি আসলেই আরো উদার সমাজ চায়? যদিও এই বিতর্কটা সবচেয়ে বেশি জোরালো নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে।
২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌদিদের দু-তৃতীয়াংশই অনলাইনে প্রতি সপ্তাহে একটি করে সিনেমা দেখে। ১০ জনের ৯ জনের হাতেই স্মার্টফোন আছে। জানা যায়, ওই সময় অনেকে সস্তা প্লেনের টিকিট নিয়ে বাহরাইন বা দুবাইয়ে সিনেমা দেখতে যেত। সৌদি বিমান সংস্থার ফ্লাইটে সিনেমা দেখানো হয়, তবে সেখানে মেয়েদের খোলা বাহু বা মদের বোতলের মতো ‘অনুচিত’ জিনিসের দৃশ্য ঝাপসা করে দেয়া হয়।
আসলে সৌদি আরবে সিনেমার ওপর নিষেধাজ্ঞা জনমতের কারণে আরোপ করা হয়নি, করা হয়েছিল মৌলবীদের সন্তুষ্ট করতে।
দেশটির গ্রান্ড মুফতি বলেছিলেন, সিনেমায় নির্লজ্জ এবং অনৈতিক জিনিস দেখা যেতে পারে এবং তা নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা উৎসাহিত করতে পারে। একসময় এসব কথা বড় আলোচনা তৈরি করতো। এখন আর তা করে না।
আজকের সৌদি সরকার মনে করছে যে এই ধর্মীয় নেতাদের হাতে বেশি ক্ষমতা থাকা রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক, কারণ তা উগ্রপন্থা উস্কে দিতে পারে বা রাজনৈতিক ক্ষমতা-ভাগাভাগির দাবিও তুলতে পারে। এখন বরং সৌদি সরকার ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামীতে এই ধর্মীয় নেতাদের হাতে ক্ষমতা ও প্রভাব থাকবে আগের চাইতে কম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ