আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার হারানোর শঙ্কা সেই শুরু থেকেই। সময় যতো গড়াচ্ছে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে সেই শঙ্কা।
আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতা নেওয়ার প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে যাওয়া থেকে এখনও বঞ্চিত রয়ে গেছে আফগান কিশোরীরা। দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের স্কুলছাত্রী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রায় তিনমাস আগে যখন তালিবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন দেশটিতে নারী শিক্ষায় বাধা আসতে পারে। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্বদের সেই ধারণা এখন প্রায় সত্যি হতে চলেছে। মেয়েদের নিরাপত্তার উছিলা দেখিয়ে প্রথমে শুধু ছেলে শিক্ষার্থীদেরই স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল তালিবান সরকার। নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পারলেই মেয়েদেরকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে, এমনটাই তখন বলা হয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়। কিন্তু, সেই নিরাপত্তার ব্যাপারটি যেন নিশ্চিতই করতে পারছে না তালিবান সরকার।
বাদাখশান প্রদেশের ১৫ বছরের স্কুলছাত্রী মীনা বিবিসিকে বলেছে, ‘পড়াশোনা করতে না পারাটা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো।’ স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে মীনা এবং তার বান্ধবীদের মধ্যে একরকম পরাজিত ও দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতা জেঁকে বসেছে।
তাখার প্রদেশের ১৬ বছর বয়সী লাইলা বলছে, ‘ঘরের কাজকর্মের বাইরে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা এক বদ্ধ জায়গায় আটকে আছি।’
তেরো প্রদেশের শিক্ষার্থী ও প্রধান শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। মাধ্যমিক স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় মেয়েরা ব্যাপক হতাশার কথা জানিয়েছে। তালিবানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ স্কুল চালু করা হবে।
তা ছাড়া এসব স্কুলের শিক্ষকেরা প্রায় সবাই গত জুন থেকে বেতনাদি পাচ্ছেন না বলে জানান।
কাবুলের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক হোয়াটসঅ্যাপে বিবিসির সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা সত্যিই হতাশ। তারা মানসিকভাবে চাপে রয়েছে। আমি তাদের আশা দেখানোর চেষ্টা করছি শুধু।’
এদিকে, প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল চালু থাকলেও ব্যাপকভাবে মেয়েশিশুদের উপস্থিতি কমে গেছে বলে জানান শিক্ষকেরা। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এর পেছনে অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন শিক্ষকেরা।
তালিবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হাকিম হেমাত বিবিসিকে জানিয়েছেন, আগামী বছর নতুন শিক্ষানীতি অনুমোদন হওয়ার আগপর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের মেয়েশিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারবে না।
তবে এ সত্ত্বেও কিছু কিছু জায়গায় স্থানীয় তালিবান নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়।
বলখ প্রদেশের মাজার-ই-শরিফ অঞ্চরের একজন প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই তার স্কুল খোলা রয়েছে। মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে আসছে।
মাজার-ই-শরিফের আরেকটি এলাকার শিক্ষার্থীরা বিবিসিকে বলেছে, তাদের স্কুলে যাওয়ার পথে তালিবান যোদ্ধারা মেয়েদের চুল ও মুখ ঢেকে রাখতে বলে। এর ফলে তাদের স্কুলের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ভয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুল চালু থাকলেও ব্যাপকভাবে মেয়েশিশুদের উপস্থিতি কমে গেছে বলে জানান শিক্ষকেরা। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এর পেছনে অনেকটা দায়ী বলে মনে করেন শিক্ষকেরা।
তিনটি প্রদেশের প্রধান শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, তারা স্কুল খুলেছিলেন শুধু বন্ধের নোটিশ দেওয়ার জন্য। কিন্তু, স্কুল কবে চালু হবে, তা জানাতে পারেননি তারা। মেয়েরা প্রতিদিনই স্কুল গেটে আসে আর জিজ্ঞেস করে—কবে তাদের স্কুল খুলবে?
১৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর তালিবান আগের কঠোর মনোভাব থেকে সরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নারীদের স্কুলে ফেরা এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাসহ নারীদের প্রতি তালিবানের বিরূপ মনোভাব অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে শিক্ষার্থী এবং পুরুষ শিক্ষকদের ফেরার অনুমতি দেয় তালিবান সরকার। কিন্তু মেয়েদের স্কুলে ফেরার অনুমতি দেয়নি। তারা কবে স্কুলে ফিরতে পারবে বিষয়টি স্পষ্টও করেনি। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে আফগান তালিবান সরকার। এ ছাড়া নারীদের নতুন সরকারেও রাখা হয়নি।
এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। কেনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারতো না, বাইরে কাজ করতে পারতো না। সবাইকে বোরকা ও হিজাব পরিধান করতে হতো এবং বের হতে হলে পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যকে বাধ্যতামূলত সঙ্গে রাখা লাগতো। এছাড়া তাদের জোর করে বাল্যবিবাহ দিতো তালিবান শাসকগোষ্ঠী।
তবে এবার ক্ষমতায় এসে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইসলামি আইনের অধীনে তারা এবার নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে। যদিও সেটিতে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আফগান নারীরা।
এর মাঝেই তালিবান নির্দেশ দিয়েছে, নারীরা যেন আপাতত ঘরে থাকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা অনেক তালিবান সদস্য এখনো জানে না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই নারীরা বাইরে কাজের সুযোগ পাবে। তবে এটাকে তালিবানের এক প্রকার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে পুরো পাল্টে গেছে দেশটির চেহারা। একের পর এক এলাকার দখলে নিয়েছে তালিবান। এরই মধ্যে আফগান নারী ও পুরুষের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের বোরকা পরতে হবে। এ ছাড়া এ সময় তাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে। ফলে নারীদের বাইরে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নারীরা।
তালিবান শরিয়া মোতাবেক নারী স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও আফগান নারীদের আতঙ্ক কাটেনি। তারা বলছেন, তালিবানের অতীত শাসনে যেভাবে নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় তারা।
আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙায় তালিবানের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া তালেবানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে দেখে আমি বিশেষ শঙ্কিত। আমি জোরালোভাবে তালিবানকে নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৬
আপনার মতামত জানানঃ