মহাবিশ্বের এমন কিছু তারকা বা নক্ষত্র আছে, যারা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোন বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়, হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট, তা-ই ব্ল্যাকহোল। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন ‘ব্ল্যাকহোল’।এই তারকাদের অস্বাভাবিক আকার, ভর ও ঘনত্ব থাকে, আর এর জন্যে এই সব তারকা থেকে নির্গত আলো বাইরে আসতে পারে না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে— যখন একটি তারকার জীবনকাল শেষ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার অভিকর্ষ শক্তি এতই প্রবল হয় যে আলো ওখান থেকে বের হতে পারে না। আর এই ঘটনা তখনই ঘটে যখন একটি তারকার জীবনকাল অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। তারকাটি পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে। এভাবেই একটি ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়।
মহাকাশের এক অনন্ত বিস্ময় এই ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোলকে কৃষ্ণবিবর, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি বলা হয়। জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বিশেষ স্থান যেখান থেকে কোন কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। মহাকাশীয় এই দানবের কাছে পথ হারায় আলোকতরঙ্গ।
সম্প্রতি এ যাবতকালের মধ্যে খুব কাছাকাছি বিশাল আকারের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন জ্যোতির্বিদরা। এর দূরত্ব মাত্র ৮ কোটি ৯০ লাখ আলোকবর্ষ। এর অবস্থান এনজিসি ৭৭২৭ নামের ছায়াপথে। এর আগে যেসব কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কৃত হয়েছে তার দূরত্ব ৪৭ কোটি আলোকবর্ষ। ফলে নতুন আবিষ্কার করা কৃষ্ণগহ্বর সবচেয়ে কাছের। তবে এই দুটি কৃষ্ণগহ্বর বা ব্লাকহোলের মধ্যে দূরত্ব ১৬০০ আলোকবর্ষ।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই দুটি কৃষ্ণগহ্বর ক্রমশ বড় হবে এবং একটি আরেকটির কাছাকাছি চলে আসছে। একসময় তারা একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে যাবে। এর মধ্য দিয়ে দুই কৃষ্ণগহ্বর মিলে একটি বিশাল কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। এই আবিষ্কারের ফলে শুধু এটাই প্রমাণ হয়নি যে, এনজিসি ৭৭২৭ ছায়াপথ এই দুটি ছায়াপথের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে বিষ্ময়কর সব তথ্য দিচ্ছে যে, কিভাবে বিশাল ভরের ব্লাকহোলগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত হয়।
ফ্রান্সের স্ট্রাসবোর্গ অবজার্ভেটরির জ্যোতির্বিদ কারিনা ভোগেল বলেছেন, প্রথমবারের মতো আমরা দুটি বিশাল ভরের ব্লাকহোলের সন্ধান পেলাম। তারা একটির খুব কাছে রয়েছে আরেকটি। এর আগের ব্লাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে মিলিত হওয়ার জন্য যে দূরত্ব বলা হয়েছিল, এদের ক্ষেত্রে সেই দূরত্ব অর্ধেকের কম।
বিশাল ভরের এসব কৃষ্ণগহ্বরের জোড়া নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আগ্রহের বহু কারণ আছে। বেশির ভাগ ছায়াপথেই পাওয়া যায় বিশাল ভরের কৃষ্ণগহ্বর। এটি থাকে কেন্দ্রে— নিউক্লিয়াসের মতো। আর সবকিছু তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যখন দুটি কৃষ্ণগহ্বর একসঙ্গে দেখা গেছে, তখন এ থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, দুটি ছায়াপথ একত্রিত হয়েছে। আমরা জানি এ প্রক্রিয়া ঘটমান।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই দুটি কৃষ্ণগহ্বর ক্রমশ বড় হবে এবং একটি আরেকটির কাছাকাছি চলে আসছে। একসময় তারা একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে যাবে। এর মধ্য দিয়ে দুই কৃষ্ণগহ্বর মিলে একটি বিশাল কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে।
মহাকাশে আমাদের সূর্যের চেয়ে কোটি কোটি গুণ ভারি বস্তু আছে। এসব নক্ষত্র বা বস্তু এত অবিশ্বাস্যরকম ভারি কেন হয় তার ব্যাখ্যা করে বিশাল ভরের এমন জোড়া কৃষ্ণগহ্বর। এমন জোড়া কৃষ্ণগহ্বর একটি অন্যটির কাছাকাছি আসতে আসতে তার আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিভাবে আকার বৃদ্ধি পায় তা বুঝতে এই ভারি দুটি কৃষ্ণগহ্বর আমাদেরকে সাহায্য করবে। এ থেকে নতুন এবং অধিক নির্ভেজাল মডেল বেরিয়ে আসবে।
সাধারনত ব্ল্যাকহোল তৈরি হয় বৃহৎ কোন নক্ষত্রের নিজ কেন্দ্রে সংকুচিত হওয়ার ফলে। প্রতিটি নক্ষত্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে হিলিয়াম অণু গঠন করে। দুটি হাইড্রোজেন অণু নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি হিলিয়াম অণু গঠন করার মাধ্যমে প্রচুর তাপশক্তি, আলোক শক্তি ও বিভিন্ন ধরনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ করে। কিন্তু নক্ষত্রের এই নিউক্লীয় জ্বালানি(হাইড্রোজেন) শেষ হয়ে গেলে তাদের নিউক্লীয় বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, যা নক্ষত্রটিকে একটি মৃত নক্ষত্রে পরিনত করে। প্রতিটি বস্তুর ন্যায় এসকল নক্ষত্রেরও অভিকর্ষ বল থাকে। এ সময় চন্দ্রশেখর সীমার নিচের নক্ষত্র গুলো White Dwarf বা শ্বেত বামনে পরিণত হয়। চন্দ্র শেখর সীমার ওপরের নক্ষত্র গুলোর ক্ষেত্রে এইরকম ঘটে না। এই বৃহৎ নক্ষত্রগুলির অভ্যন্তরে প্রচুর পদার্থ অবশিষ্ট থাকে এবং অত্যাধিক অভিকর্ষ বলের সৃষ্টি করে। ফলে একধরনের কেন্দ্রমুখী সংকোচনধর্মী চাপ সৃষ্টি হয়। এভাবে ধীরে ধীরে সমস্ত ভর কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হতে শুরু করে। এরা বাইরের ও ভিতরের চাপ সমান করতে গিয়ে এক অতি বৃহৎ বিস্ফোরণের তৈরি করে নিজের ভিতরের কিছু অংশ বাইরের দিকে প্রচণ্ড বেগে বের করে দেয়। এই অতি বৃহৎ বিস্ফোরণ “সুপারনোভা” নামে পরিচিত। এই বিস্ফোরণের কারণে নক্ষত্রের বাইরের পৃষ্ঠটি মহাশুন্যে নিক্ষিপ্ত হবে এবং অভ্যন্তরটি পরিণত হবে একটি ব্ল্যাকহোলে।
১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার “জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব ” দিয়ে ধারণা করেন ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব। আর ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারীরা প্রমাণ করেন আসলেই ব্ল্যাকহোল আছে। এটি কোন সায়েন্স ফিকশন নয়। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান, যেকোন তারকা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে।
ব্ল্যাকহোল ছোট হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষুদ্রতম ব্ল্যাকহোল একটি পরমাণুর সমান হতে পারে। এই জাতীয় ব্ল্যাকহোলগুলো অনেক ক্ষুদ্র কিন্তু তাদের এক একটার ভর হতে পারে বিশাল কোন পর্বতের সমান। অন্য এক ধরনের ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “স্টেলার” বা “নাক্ষত্রিক”। এর ভর আমাদের সূর্যের ভর এর চেয়েও ২০ গুণ বেশি হতে পারে।
খুব সম্ভবত অনেক অনেক বেশি ভরেরও নক্ষত্র রয়েছে পৃথিবীর ছায়াপথে। আর পৃথিবীর এই ছায়াপথকে বলা হয় “মিল্কিওয়ে”। সবচেয়ে বৃহৎ ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “সুপারমেসিভ”। কৃষ্ণবিবরকে ভাগ করা হয় তার মাঝে থাকা ভর, আধান, কৌণিক ভরবেগের উপর ভিত্তি করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৮
আপনার মতামত জানানঃ