আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার হারানোর শঙ্কা সেই শুরু থেকেই। সময় যতো গড়াচ্ছে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে সেই শঙ্কা।
নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
সম্প্রতি নাটকে নারীদের অভিনয় নিষিদ্ধ, নারী সাংবাদিকদের ড্রেস কোডসহ কয়েকটি নতুন নির্দেশনা নিয়ে আফগানিস্তানে গণমাধ্যমে ‘ধর্মীয় নির্দেশিকা’ প্রকাশ করেছে তালিবান সরকার।
আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের নতুন জারি করা নিয়ম অনুযায়ী, দেশটির টেলিভিশন নাটকে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, নারী সাংবাদিক ও উপস্থাপিকাদেরও হিজাব পরে টেলিভিশন পর্দায় আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আফগানিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি নাটক দেখানো হয়। যেগুলোর প্রধান চরিত্রে থাকেন নারী।
আফগানিস্তানে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন, হুজ্জাতুল্লাহ মুজাদ্দেদির এক সদস্য বলেছেন, নতুন এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা অপ্রত্যাশিত।
তিনি বিবিসিকে বলেছেন যে, কিছু নিয়ম বাস্তবসম্মত নয় এবং তা কার্যকর হলে সম্প্রচারকারীরা টেলিভিশন অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হতে পারেন।
তালিবান এর আগে মেয়ে এবং তরুণীদের স্কুল থেকে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন।এর পরপরই আফগানিস্তান তার অর্ধেক জনসংখ্যাকে শিক্ষা অর্জনে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
রাজধানী কাবুলের মেয়র, নারী পৌর কর্মীদেরও বাড়িতে থাকতে বলেছেন, যতক্ষণ না তাদের চাকরির স্থলে একজন পুরুষকে বসানো হচ্ছে। তবে তালেবানে দাবি, কর্মরত নারী এবং শিক্ষা গ্রহণকারী ছাত্রীদের ওপর তাদের এসব নিষেধাজ্ঞা ‘অস্থায়ী’। তাদের জন্য কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষার পরিবেশ পুরোপুরি ‘নিরাপদ’ করার জন্যই এ ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
নাটকে নারীদের অভিনয় নিষিদ্ধ, নারী সাংবাদিকদের ড্রেস কোডসহ কয়েকটি নতুন নির্দেশনা নিয়ে আফগানিস্তানে গণমাধ্যমে ‘ধর্মীয় নির্দেশিকা’ প্রকাশ করেছে তালেবান সরকার।
তালিবানের এ গাইডলাইন বা ‘ধর্মীয় নির্দেশিকা’ নারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার নতুন রূপ বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী এবং অনেক পেশাজীবী নারী। এ নির্দেশনার অজুহাতে নারী সাংবাদিকদের হেনস্তা করা হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
তালিবানের এ গাইডলাইন বা ‘ধর্মীয় নির্দেশিকা’ নারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার নতুন রূপ বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী এবং অনেক পেশাজীবী নারী। এ নির্দেশনার অজুহাতে নারী সাংবাদিকদের হেনস্তা করা হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
নারীদের জন্য টিভি চ্যানেল চালু করা নারী সাংবাদিক জেহরা নবী সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘কর্মীদের নিয়ে কাজ করার নিরাপদ জায়গা পাচ্ছি না।’ তার চ্যানেল এখন বন্ধ।
আগস্টে চাকরি হারানো সাংবাদিক সোনিয়া আহমাদিয়ার বলেন, ‘গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা হচ্ছে’।
মানবাধিকারকর্মী শাকাইক হাকিমি বলেন, ‘এভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে আমরা সেটা মেনে নেব না।’
এর আগে গত সপ্তাহে নির্দেশিকা প্রকাশের পর উদ্বেগ প্রকাশ করে হিউম্যান রাইট ওয়াচ।
১৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর তালিবান আগের কঠোর মনোভাব থেকে সরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নারীদের স্কুলে ফেরা এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাসহ নারীদের প্রতি তালিবানের বিরূপ মনোভাব অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। কেনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারতো না, বাইরে কাজ করতে পারতো না। সবাইকে বোরকা ও হিজাব পরিধান করতে হতো এবং বের হতে হলে পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যকে বাধ্যতামূলত সঙ্গে রাখা লাগতো। এছাড়া তাদের জোর করে বাল্যবিবাহ দিতো তালিবান শাসকগোষ্ঠী।
তবে এবার ক্ষমতায় এসে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইসলামি আইনের অধীনে তারা এবার নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে। যদিও সেটিতে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আফগান নারীরা।
এর মাঝেই গত মাসেই তালিবান নির্দেশ দিয়েছে, নারীরা যেন আপাতত ঘরে থাকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা অনেক তালিবান সদস্য এখনো জানে না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই নারীরা বাইরে কাজের সুযোগ পাবে। তবে এটাকে তালিবানের এক প্রকার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ