রাজধানীর শাহবাগ থানায় দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাংবাদিক কনক সারোয়ার ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। সম্পত্তি ক্রোকের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ আগামী ১৩ ডিসেম্বর ধার্য করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পেশকার শামীম আল মামুন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী শামীম আল মামুন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সমন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরও আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় বিচারক তাদের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন।
মামলার নথি অনুযায়ী, কনক সরওয়ার ও দেলোয়ার হোসেন ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, মানহানিকর ও উসকানিমূলক তথ্য ইউটিউবসহ অন্য মাধ্যমে প্রচার করেন। এছাড়াও তারা অ্যাটর্নি জেনারেল ও সেনাপ্রধানকে নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক তথ্যও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করেন।
২০২০ সালের ১১ অক্টোবর মো. জাকির হোসেন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ রাসেল মোল্লা চলতি বছর ৩০ জুন দুই আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
২ নভেম্বর বিচারক মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
এদিকে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে মিথ্যা, উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার আছেন সাংবাদিক কনক সারোয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন সরকার। তার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নুসরাত শাহরিনের জামিন আবেদন নাকচ করেছেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সাংবাদিক কনক সারোয়ার। পরে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
এদিকে বোনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার পর তাকে নির্দোষ দাবি করে বিবিসি বাংলায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার ভাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার। সেখানে তিনি বলেছেন, তার কারণেই তার বোনকে হেনস্তা করা হচ্ছে। ভাইয়ের বিরুদ্ধে থাকা ক্ষোভের কারণে বোনকে এভাবে হেনস্তার মাধ্যমেই বরং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
কনক সারওয়ার বলেন, ‘গত ১০/১২ দিন আগে তার নামে একটি ফেক ফেসবুক আইডি খোলা হয়। সেই আইডিতে কিছু পোস্টের পর আমার বোন জিডিও করেছিল থানায় যে তার নামে আইডি খুলে সেখানে উদ্দেশ্যমূলক বিভিন্ন বিষয় দেয়া হচ্ছে। সে আসলে বিচারপ্রার্থী ছিল। এখন বিচার প্রার্থীকেই আসামি করা হয়েছে কারণ সে আমার ছোট বোন। এটিই তার অপরাধ। আমি মনে করি ফেসবুক আইডি থেকে শুরু করে যা কিছু করা হয়েছে সবগুলোই পরিকল্পনা বা নীলনকশার অংশ।’
তিনি সরকারের সমালোচনা করলেও কখনোই রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করেননি বলে দাবি প্রবাসী এই সাংবাদিকের।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী হয়ে ২০১৫ সালে নয় মাস জেল খাটার পর ২০১৬ সালে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কনক সরওয়ার সরকারের সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছেন।
বাংলাদেশে ভিন্নমত দমন করতে অ্যাক্টিভিস্ট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
তবে বাংলাদেশে সরকারের সমালোচকদের হাতের কাছে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের হেনস্তার অভিযোগ নতুন নয়।
ব্লগার আসাদ নুরও তার পরিবারের সদস্যদের হেনস্তার অভিযোগ করেছিলেন। সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনীম খলিল সিলেটে তার মাকে ভয়ভীতি দেখানো, ফ্রান্সে থাকা অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য বগুড়ায় তার বৃদ্ধ মা এবং মামাকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, ব্লগার আসাদ নূর তার বরগুনার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বাবা-মাসহ পরিবারের ছয় জন সদস্যকে দু’দিন আটক রাখার অভিযোগ করেছেন।
এর জের ধরে বাংলাদেশে ভিন্নমত দমন করতে অ্যাক্টিভিস্ট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানির অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এসব অভিযোগ সরকার প্রত্যাখ্যান করলেও এভাবে নির্যাতন ও হয়রানি এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, অনেক ক্ষেত্রেই যিনিই সরকার বা ক্ষমতাধর কোন ব্যক্তির যৌক্তিক সমালোচনাও করেন এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে যদি তিনি নাগালের বাইরে থাকেন অর্থাৎ বিদেশে যদি অবস্থান করেন, তাহলে তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের ওপর খড়গহস্ত নেমে আসে এবং নানা ভাবে তাদের হয়রানি করেই ক্ষান্ত হয় না, নির্যাতন নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় ভয়ের পরিস্থিতি তৈরির জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় বা মামলা মোকাদ্দমায় জড়িয়ে দেয়া হয়।যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে গত কয়েক বছর।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। অন্য দুটি হলো নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা বা সংসদ। একটি ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তা-ই, যেখানে তিনটি বিভাগই সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে এবং থাকবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগের বাইরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ রয়েছে। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা অস্বীকার করে না কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
মতামত প্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ এটি জনগণকে তথ্য ও ধারণার অবাধ প্রবাহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে সক্ষম করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত বিকাশের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি আমাদের মতবিরোধ এবং শোনার অধিকার দেয়। বিভিন্ন চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশের দ্বারা আমরা আমাদের মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে নিজস্ব পছন্দ পোষণ করতে পারি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে কালো আইনের মাধ্যমে সরকার তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। কেউ যেন এই সরকারের নানা দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে, সেই জন্যই এই সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট তৈরি করে মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে চায়।
তারা বলেন, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা— এটা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। যে অধিকার আইন করেও খর্ব করা যায় না। দুর্ভাগ্যবশত আজকে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন করার পরও আমরা এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৯
আপনার মতামত জানানঃ