বিশ্ব অর্থনীতি করোনা অতিমারির ধাক্কা সামলে আবার সচল হয়ে উঠছে, যার অনুকূল প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ের ওপরও। ২০২১ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে (চীন বাদে) প্রবাসী আয় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আগের অনুমানগুলো থেকে বেশি।
২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে বাংলাদেশ সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়। চলতি বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২ হাজার ৩০০ কোটি (২৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স আসবে। যা ২০২০ সালের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি।
বুধবার (১৭ নভেম্বর) বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ‘কোভিড-১৯ পুনরুদ্ধার: আয়নায় অভিবাসন ২০২১’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৭.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮৯ বিলিয়নে পৌঁছেছে। এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার রেমিট্যান্স প্রবাহ ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫৯ বিলিয়ন হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবাসী আয়ের পরিমাণের দিক থেকে এ বছর বিশ্বে প্রথম ভারত (৮৭ বিলিয়ন ডলার)। শীর্ষ বাকি ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে চীন (৫৩ বিলিয়ন ডলার), মেক্সিকো (৫৩ বিলিয়ন ডলার), ফিলিপাইন (৩৬ বিলিয়ন ডলার), মিশর (৩৩ বিলিয়ন ডলার), পাকিস্তান (৩৩ বিলিয়ন ডলার), বাংলাদেশ (২৩ বিলিয়ন ডলার), ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া ও ইউক্রেন।
বিশ্বব্যাংক বলছে, এ বছর বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলেই প্রবাসী আয় বাড়ছে। তবে সবচেয়ে বেশি বাড়ছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে, প্রায় ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় আট শতাংশ, সাব-সাহারান আফ্রিকায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এমনকি চীনকে বাদ দিয়ে পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রবাসী আয়ও বাড়ছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
তবে ২০২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বেশ চড়া লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্বব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রাইস ডেটাবেজ অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্বজুড়ে রেমিট্যান্স খরচ ছিল গড়ে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) নির্ধারিত তিন শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মধ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ সবচেয়ে বেশি সাব-সাহারান অঞ্চলে। সেখানে ২০০ ডলার পাঠাতে গেলে আট শতাংশ অর্থাৎ ১৬ ডলার খরচ করতে হয়। বিপরীতে, রেমিট্যান্স খরচ সবচেয়ে কম দক্ষিণ এশিয়ায়। এ অঞ্চলের দেশগুলোতে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ গড়ে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রেমিট্যান্স দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। ২০২১ সালে এফডিআই এর চেয়েও দ্বিগুণেরও বেশি রেমিট্যান্স প্রাপ্ত হয়েছে। তেলের উচ্চমূল্য অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অর্ধেকের বেশি অভিবাসীর কর্মস্থল জিইসিভুক্ত দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানোর গড় খরচ ৪.৬ শতাংশ। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল বিধায় এই দেশগুলোতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্থ পাঠানো জনপ্রিয়।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি বছর দক্ষিণ এশিয়ায় ১৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় ঢুকতে পারে। এর মধ্যে ভারতের আয় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে। একই সময় পাকিস্তানের প্রবাসী আয় বাড়তে পারে রেকর্ড ২৬ শতাংশ। এ বছর দেশটি ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বছর দক্ষিণ এশিয়ায় এফডিআইয়ের চেয়ে প্রবাসী আয় দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির হিসাবে, বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ সবচেয়ে কম। তবে এ অঞ্চলে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর চেয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি বা অন্য চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর খরচ এখনো কম। এ কারণে প্রবাসীরা এসব চ্যানেল ব্যবহারেই বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় রেমিট্যান্স সংক্রান্ত সাশ্রয়ী নীতি চালুর মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় সরকার ও প্রবাসী উভয়ই লাভবান হতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
করোনার মধ্যে কেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রবাসী আয় বেড়েছে, তা নিয়ে ১৩ জুলাই একটি মতামত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ছয় কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণগুলো হলো প্রবাসীদের সঞ্চয় দেশে পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধি, বৈধ পথে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি, দেশে থাকা পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীলতা, অর্থ প্রেরণের নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, কর ছাড় ও বড় দেশের প্রণোদনার অর্থের কিছু অংশও আসা।
গত ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ২ হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে এসেছে। করোনার মধ্যেও তখনপ্রবাসী আয়ে ১৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়। আর বর্তমানে প্রবাসী আয় পাঠানোয় পুরো বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সিপ্তম। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ওপরে আছে কেবল ভারত ও পাকিস্তান।
বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এই আয় ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১ হাজার ৮০৩ কোটি ডলারের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। গত এক বছরে প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন, তা দিয়ে দেশে সাতটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু তৈরিতে মোট ব্যয় হবে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৬
আপনার মতামত জানানঃ