পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। এই কেনিয়ার পাহাড়ী সবুজ-শ্যামল-সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠেছে এক গ্রাম ‘উমোজা’। আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী যে রূপ দেখা যায়, ঠিক তেমন রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর গ্রামটি। কেনিয়ার সুন্দর সরল এক গ্রাম উমোজা। তবে নারীদের গ্রাম হিসেবেই উমোজা পরিচিত বিশ্বব্যাপী। কারণ পুরুষদের এ গ্রামে প্রবেশ করা নিষেধ।
সোয়াহিলি ভাষায় ‘উমোজা’ মানে ঐক্য। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ৬ ঘণ্টার পথ এই গ্রামের নাম কেনিয়া ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের নানা দেশে। এই গ্রামের কথা জানে না এমন মানুষ কেনিয়াতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ নাম মনে থাকার মতো দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন উমোজা’র নারী গোষ্ঠী।
কীভাবে গঠিত হলো নারীদের এই গ্রাম
কেনিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম সাম্বুরু। এই গ্রামে সাম্বুরু আদিবাসীদের বাস। এ ছাড়াও তুর্কানা এবং অন্যান্য আদিবাসীও আছে কয়েক জন।
বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের নানা আদিবাসী নারীদের মতো সাম্বুরু নারীরাও সমাজের পিছিয়ে পড়া সারিতে ছিলেন। তাদের গণ্য করা হত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে। সাম্বুরুর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের প্রায় নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন পুরুষেরা।
কিছু সামাজিক কুপ্রথার জন্য তাদের যৌনাঙ্গহানি, অকথ্য নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। জোর করে নাবালিকাদের বিয়েও দেওয়া হতো। একাধিক পুরুষের ধর্ষণের শিকারও হতেন তারা। এমনকি স্বামীর ইচ্ছা হলে স্ত্রীকে হত্যাও করতে পারতো।
নারীদের পাশে দাঁড়ানোর ছিল না কেউ। বরং স্বামীকে সমর্থন করার জন্য আরও অনেক পুরুষ তৈরি থাকত। নারীদের জন্য এ রকমই নিষ্ঠুর ছিল সাম্বুরু। মূলত স্বামীর সম্পত্তি হয়েই জীবন কাটাতেন সেখানকার নারীরা।
এই নির্যাতন সহ্য করতে করতে এক সময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল সাম্বুরু নারীদের। এরপরই গড়ে উঠল ‘উমোজা’; নারীদের নিজস্ব গ্রাম। যেখানে পুরুষের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৯৯০ সালে রেবেকা ললোসলি নামে এক নারী নির্যাতিত এবং বিতাড়িত আরও কয়েকজন নারীকে নিয়ে এই পুরুষমুক্ত গ্রাম গড়ে তুলেছিলেন।
রেবেকা নিজেও একজন নির্যাতিতা। সাম্বুরুতে নিযুক্ত সেনারা নির্যাতন চালাতো নারীদের উপর। তাদের নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করতো সেনারা। যখন তখন নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে চলতো ধর্ষণ।
এক সময় একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজার সাম্বুরু নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। সে সময় স্বামীদেরও তারা পাশে পাননি। স্বামীরা উল্টো তাদের বাড়িছাড়া করেছিল। সেই দলে রেবেকাও ছিলেন। এমন আশ্রয়হীন ১৫জন নারীকে নিয়েই নিজেদের জন্য গ্রাম গড়ে তোলেন রেবেকা।
এখন সাম্বুরুর সমস্ত নির্যাতিতারা এই উমোজাতেই আশ্রয় নেন। এই গ্রামে শুধুমাত্র নারীদের কথাই চলে। মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচেন তারা। বহু অন্তঃসত্ত্বাও এখানে ঠাঁই নেন। যদি তারা পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, তা হলে সন্তানের ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত সেই সন্তান এই গ্রামে থাকার অনুমতি পায়। ১৮ বছর হয়ে গেলে তাকে উমোজা ছাড়তে হয়।
পুরুষ না থাকলেও গর্ভবতী হচ্ছে নারীরা
তবে আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর এই গ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উদ্ভট ঘটনার দেখা মিলেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামটিতে পুরুষ না থাকলেও সেখানকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন, সন্তানও জন্ম দিচ্ছেন।
গত ২৭ বছর ধরে গ্রামটিতে ঘটছে এমন ঘটনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা বেশ বেড়েছে। পুরুষশূন্য গ্রামে প্রতি বছর কোনো না কোনো নারী সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। ফলে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে।
সূত্র মতে, উমোজা গ্রামের নারীরা গ্রাম থেকে বেরিয়ে নিজের পছন্দের পুরুষকে খুঁজে নেন এবং ওই ব্যক্তির সন্তান জন্ম দেন। তবে তারা একে অপরকে বিয়ে করেন না।
২০১৫ সালে এই গ্রামে বসবাসকারী নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭। এখন সেখানে প্রায় ২৫০ জন নারীর বসবাস। এই গ্রামের প্রত্যেক নারীই স্বনির্ভর। তারা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই গ্রামের নারীদের তৈরি গহনা বর্তমানে সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
গোটা বিশ্বের কাছে অনুসরণীয়
২০১৫ সালে কেনিয়ায় এসেছিলেন বারাক ওবামা। উমোজার এই গ্রামে ঘুরে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি; বলেছিলেন, ‘বিশ্ব জুড়েই নারীদের দমিয়ে রাখার একটি রীতি রয়েছে। নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হয়। এ সমস্ত কু-রীতিনীতি বদলানো প্রয়োজন। অঙ্গহানি, বালিকা বিবাহের মতো প্রথাগুলো অনেক পুরনো। এই শতাব্দীতে এগুলোর কোনও জায়গা থাকা উচিত নয়।’
উমোজার ভিন্ন জীবন ব্যবস্থা, নারীর সংগ্রামের গল্প আর অসাধারণ বৈচিত্র্যে ভরা জীবনধারা সম্পর্কে জানতে, নতুন এক পৃথিবী গড়ার অনুপ্রেরণায় অনেক পর্যটক ভিড় জমান উমোজায়। আর সেটি ঘিরেই উমোজার নারীরা গড়ে তুলেছেন ছোট্ট আয়োজন, যাতে এই গ্রামের অভিজ্ঞতা সবসময় মনে গেঁথে থাকে সবার মনে। কেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানে অতিথিদের বরণ করে নেয় উমোজা’র সংগ্রামী নারীরা।
মূলত ২০০৪ কিংবা ২০০৫ সালের দিকে উমোজার নারীরা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য। এরপর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুপ্রেরণার খোঁজে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।
তবে এতকিছুর পরও আফ্রিকার পুরুষসমাজের বিভিন্ন অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করে চলেছে তারা। এখনো পুরুষশাসিত সমাজ সঠিকভাবে নিতে পারেনি নারীদের এই বীরত্বগাঁথা। তবে সবকিছু ছাপিয়েই উমোজার নারীরা এগিয়ে চলছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ