চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে কর্মী পাচ্ছে না মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার মার্কিন নাগরিকরা দলে দলে চাকরি ছাড়ছেন। এ প্রবণতা মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এ সময়ে কর্মীদের আত্মবিশ্বাসের বিষয়টি তুলে ধরে। কর্মীরা আরো ভালো সুযোগ পাওয়ায় বর্তমান চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চাকরি ছেড়েছেন ৪৪ লাখ মার্কিন নাগরিক। করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে ওঠার এই মুহুর্তে ভালো বেতনের আশায়, নতুন কাজের সন্ধানে পুরনো কাজ ছেড়েছেন তারা। এর আগের মাসে চাকরি থেকে সরে দাঁড়ান ৪৩ লাখ মার্কিনি। স্থানীয় সময় গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের (বিএলএস) এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি আমেরিকার শ্রমবাজারে মৌলিক পরিবর্তন আনতে চলেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএটুডের খবরে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি ছাড়ার হার ৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, যখন লোকজন স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন, এর অর্থ তারা অন্য কোনো চাকরি খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী।
বিএলএসের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত ১ কোটি ৪ লাখ চাকরির বিজ্ঞাপন এসেছে। এর মধ্যে ৬৫ লাখ লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগের মাসেও একই সংখ্যক মানুষ নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা খাতে চাকরির বিজ্ঞাপন বেড়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার। রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে বিজ্ঞাপন বেড়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার। রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের এ হিসাব অবশ্য শিক্ষা খাত বাদে। অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসা–বাণিজ্যে নতুন বিজ্ঞাপন বেড়েছে ৫১ হাজার। তথ্য খাতেও একই পরিমাণ বাড়তি বিজ্ঞাপন এসেছে।
অন্যদিকে আগের তুলনায় রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের শিক্ষা খাতে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমেছে ১ লাখ ১৪ হাজার। আবাসন খাতে কমেছে ৬৫ হাজার। আর অন্য সেবা খাতগুলোতে বিজ্ঞাপন কমেছে ১ লাখ ৪ হাজার।
বিএলএসের হিসাব বলছে, চাকরি ছাড়ার বাইরে সেপ্টেম্বরে ১৪ লাখ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এ পরিমাণ মোট চাকরিজীবীর শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ কোটি ৩৩ লাখ মানুষের চাকরি হয়েছে। চাকরি ছেড়েছেন এবং ছাঁটাই করা হয়েছে ৬ কোটি ৭৭ লাখ জনকে। এর অর্থ, গত এক বছরে চাকরি হারানোর বিপরীতে ৫৬ লাখ নিয়োগ বেশি হয়েছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চাকরি ছেড়েছেন ৪৪ লাখ মার্কিন নাগরিক। করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে ওঠার এই মুহুর্তে ভালো বেতনের আশায়, নতুন কাজের সন্ধানে পুরনো কাজ ছেড়েছেন তারা। এর আগের মাসে চাকরি থেকে সরে দাঁড়ান ৪৩ লাখ মার্কিনি।
এছাড়া উৎপাদন, নির্মাণ, পরিবহন ও গুদামজাতের মতো শিল্পেও চাকরি ছাড়ার সংখ্যা বাড়ছে। আইন, প্রকৌশল ও স্থাপত্যের মতো পেশাগত ও ব্যবসায়িক পরিষেবাগুলোয় চাকরি ছাড়ার হার স্বাভাবিকের কাছাকাছি ছিল। বাড়ি থেকে কাজের সুযোগ থাকায় এ খাতগুলোয় চাকরি ছাড়ার প্রবণতা কিছুটা কম। রেকর্ড হারে চাকরি ছাড়ার পেছনে বেশকিছু কারণের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য মরিয়া এবং কর্মীদের সামনে উচ্চ বেতন ও অধিক সুযোগ-সুবিধা হাতছানি দেয়ায় চাকরি ছাড়ার প্রবণতা বেড়েছে।
আরএসএম ইউএস-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসেফ ব্রুসুলাস বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির চেয়ে কম টাকা দেওয়ার যুগের অবসান হয়েছে। বর্ধিত মজুরি এখন ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে চলেছে।
ইন্ডিড হায়ারিং ল্যাবের অর্থনৈতিক গবেষণা বিভাগের পরিচালক নিক বাংকার বলেন, সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখনও দৃশ্যমান। তবে, আমরা অক্টোবরের চাকরির পরিসংখ্যান প্রতিবেদন থেকে জানতে পেরেছি, এর মাঝেও শ্রমবাজার আরো স্থিতিশীল হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভালো বেতনের চাকরির আশায় অনেক মানুষ বর্তমান চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেও, অনেক খাতেই বেড়েছে কাজ করার সুযোগ। তুলনামূলকভাবে কম মজুরি দেওয়া হয় এমন খাতেই চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
শিল্পকলা, বিনোদন ও সৃজনশীল খাতে চাকরি ছাড়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এরপরে রয়েছে, অন্যান্য পরিষেবা খাত।
মহামারি আঘাত হানার আগে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির ঘাটতি রয়েছে ৪.৭ মিলিয়ন। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংকটে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি কম থাকলেও, অক্টোবর নাগাদ তা আবারও বেড়েছে। গত সপ্তাহের চাকরির পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
গত বছর পরিস্থিতি একেবারেই অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল করোনাকালে। দেশে বাড়তে থাকা সংক্রমণের ধাক্কায় চাকরির বাজারেও গভীর সমস্যার আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবছরের শেষে এসে আমেরিকা কিন্তু আগের পরিস্থিতি ফিরে পেয়েছে। পরিসংখ্যান মানলে পরিস্থিতি কোভিডের আগের চেয়েও ভাল।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বেকারত্বের হার কেন আরও কমেনি? মনে করা হচ্ছে, এর পিছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ। বহু ক্ষেত্রেই কর্মরত নারীরা করোনা পরিস্থিতিতে কাজে বেরনোর সময় শিশুকে যথোপযুক্ত স্থানে রেখে যাওয়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। আবার অনেকে সংক্রমণের ভয়ে নিয়মিত বাইরে বেরনো এড়াতেও চাকরি থেকে দূরে সরে রয়েছেন। তাছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে যে বেকারত্ব ভাতা দেওয়া হচ্ছিল তার কারণে বহু মানুষেরই হাতে যথেষ্ট সঞ্চয় থাকায় তারা উপযুক্ত কাজ খোঁজার জন্য সময় নিতে পারছেন।
চাকরিজীবীরদের একটা বড় অংশ তাদের চাকরি ত্যাগের কারণ হিসেবে করোনার প্রভাবকে দায়ী করেছেন। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, উপযুক্ত বেতন না পাওয়ার বিষয়টি। তবে নিয়োগকর্তারা বলছেন, এখন চাকরির জন্য স্বর্ণালি সুযোগ রয়েছে, অথচ মানুষ সেই পথে হাঁটছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাপকহারে চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় শূন্যপদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এবং অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনার পথে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এমনিতেই কোভিড হানায় বিপর্যস্ত মার্কিন অর্থনীতি। এরইমধ্যে কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের আকৃষ্ট করতে জয়েনিং বোনাস ও বেতন বৃদ্ধির মতো প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিনরা চাকরি ছাড়ায়, এই পদগুলোতে যোগ্য অভিবাসীরা সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৬
আপনার মতামত জানানঃ