মহামারি করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত পৃথিবী। করোনাভাইরাস এখন পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা বদলে দিয়েছে সমাজ, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, জীবন-যাপন, সংস্কৃতি ও মানুষের চিরাচরিত আচরণ। এমনকি করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনকভাবে কমেছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর মানব শরীরে কি ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এর মধ্যে করোনার কারণে আর্থিক লাভ-ক্ষতির খতিয়ান যেমন আছে, তেমনিভাবে রয়েছে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু। গবেষকরা বলছেন, ‘বিশ্বব্যাপী কোভিডের কারণে মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে।’
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণঘাতী এই রোগটির প্রভাবে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর পাশাপাশি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালও। কিছু দেশে অবশ্য বৃদ্ধিও পেয়েছে মানুষের আয়ু।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক, মহামারিবিদ ও মেডিকেল পরিসংখ্যানবিদ নজরুল ইসলামের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, করোনা মহামারি রাশিয়া, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ডসহ ৩১টি দেশের মানুষের মোট প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ বছর কেড়ে নিয়েছে।
কোনো দেশের মানুষের গড় আয়ু হিসাবের ক্ষেত্রে ‘প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল’ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক। একটি দেশের সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সেই দেশের মানুষ কত বছর বাঁচবেন তা নির্ধারিত হয় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল অনুযায়ী।
এ কারণে কোনো দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটলে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বাড়ে; আবার সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে, অর্থাৎ যুদ্ধ-সংঘাত-অস্থিতিশীলতা-দুর্ভিক্ষ-মহামারি হলে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল কমে।
নজরুল ইসলাম তার গবেষণার কাজে ৩৭টি দেশ ও অঞ্চলের করোনা পরিস্থিতি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। গবেষণা শেষে জানা গেছে, ৩১ দেশের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল হ্রাস পেলেও এই সূচকে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে ৬টি দেশের ক্ষেত্রে অর্থাৎ তাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেড়েছে।
এগুলো হলো— তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে নজরুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে ইউরোপে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির কারণে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল যে পরিমাণ কমেছিল, করোনা মহামারির ফলে সেই তুলনায় ৫ গুণেরও বেশি পরিমাণ আয়ুষ্কাল হারিয়েছে মানুষ।
করোনা মহামারি রাশিয়া, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, পোল্যান্ডসহ ৩১টি দেশের মানুষের মোট প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ বছর কেড়ে নিয়েছে।
অতীতের বিভিন্ন বৈশ্বিক মহামারির মৃত্যু সংখ্যাকে এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হিসাব। আক্রান্ত হয়ে পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় ভুগছেন লক্ষ-কোটি মানুষ। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম ব্যাপক হারে কমেছে মানুষের গড় আয়ু।
এসব তথ্য পাওয়া গেছে সম্প্রতি করা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, করোনায় বিশ্বে শীর্ষ আক্রান্ত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের গড় আয়ু কমেছে প্রায় দুই বছর। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান দেশগুলো এবং দক্ষিণ আমেরিকার একাধিক দেশে কোভিডের প্রভাবে কমে গেছে গড় আয়ু।
মোট ২৯টি দেশে সমীক্ষা চালিয়েছিল অক্সফোর্ড। তাতে ২২টি দেশ থেকেই আয়ু হ্রাসের এই দাবির স্বপক্ষে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষকগণ। ২০১৯ সালের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে মানুষের গড় আয়ু উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এখন পর্যন্ত করোনার কারণে গোটা বিশ্বে ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর খবর মিলেছে। সেই মৃত্যুকেও এই সমীক্ষার আওতাধীন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়।
বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রে নারীদের তুলনায় পুরুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু কমেছে বেশি মাত্রায়। যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ২০১৯ সালের চেয়ে ২.২ বছর কমে গেছে, যা এ গবেষণার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
১৫টি দেশে পুরুষদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু মোটামুটি এক বছরের মত কমে গেছে। নারীদের ক্ষেত্রে একই ফলাফল পাওয়া গেছে ১১টি দেশে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে গত ৫.৬ বছরে যে অগ্রগতি হয়েছিল, কোভিড মহামারি তা মুছে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ৬০ বছরের কম বয়সী এবং যে বয়সে মানুষ কাজ করে, সেই বয়স শ্রেণির মধ্যে। আবার ইউরোপে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার বেড়েছে বেশি।
রয়টার্সের হিসাব অনুসারে, করোনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মহামারিবিষয়ক সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক ড. ঋধি কাশ্যপ বলেন, কোভিড–১৯ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কতটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, গবেষণার ফলাফলে তা বোঝা যায়।
আরও বড় পরিসরে মহামারির ক্ষতির মাত্রা নিয়ে গবেষণার জন্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকেও কোভিডে মৃত্যু সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন ড. ঋধি কাশ্যপ।
তিনি বলেন, পুরো বিশ্বে মহামারির প্রভাব আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আরও তথ্য জরুরি ভিত্তিতে প্রকাশ করতে অনুরোধ জানাচ্ছি আমরা।
এর আগে ইউএস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনা মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড় আয়ু দেড় বছর কমে গেছে।
সিডিসি জানায়, ২০২০ সালে মার্কিনিদের গড় আয়ু দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৩ বছরে। যা ২০১৯ সালে ছিল ৭৮ দশমিক ৮ বছর। ২০০৩ সালের পর মার্কিনিদের গড় আয়ুতে এটিই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। গড় আয়ু হ্রাস মূলত কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুর কারণে ঘটেছে। গড় আয়ু হ্রাসে করোনাভাইরাসজনিত মৃত্যু ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ দায়ী।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের তুলনায় নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৫ বছর বেশি। করোনা পরিস্থিতিতেও নারীদের তুলনায় পুরুষের গড় আয়ু কমেছে বেশি। পুরুষের গড় আয়ু ২০১৯ সালে ৭৬ দশমিক ৩ বছরের তুলনায় ২০২০ সালে ছিল ৭৪ দশমিক ৫ বছর। নারীদের ক্ষেত্রে, ২০১৯ সালে ৮১ দশমিক ৪ বছরের তুলনায় ২০২০ সালে নেমে আসে ৮০ দশমিক ২ বছরে।
সিডিসির তথ্যমতে, মহামারি শুরুর পর থেকে দেশটিতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৬ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যু ২০২০ সালে রেকর্ড করা হয়েছে। গড় আয়ু কমার অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনা, হত্যা, ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ