দেওয়ানি আইনের অধীনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিকেরা অমুসলিমকে বিয়ে, বিচ্ছেদ এবং সন্তানের যৌথ অভিভাবকত্বের অধিকার পেতে যাচ্ছেন। গত রোববার এই সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়- এমনটিই জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ডব্লিইএএম।
প্রসঙ্গত, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিয়ে ও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যে কোন বিষয় ইসলামি শরিয়া আইনের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত। পাশাপাশি বর্তমান সময়ে আরব আমিরাত বিশ্বের মেধাবী ও দক্ষ মানুষের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। যে কারণে দেশটি এমন আইনের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক এই পরিবর্তনের কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকেরা মুসলিম দেশগুলোর অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠার প্রবণতা দায়ী বলে মনে করছেন। তারা জানান, আঞ্চলিক বাণিজ্য হাব হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রচলিত আইনকে আন্তর্জাতিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এমন সব সংস্কার উদ্যোগের সর্বশেষ পদক্ষেপ নতুন এই বিবাহ আইন।
যা উল্লেখ আছে আইনটিতে
আবুধাবির শাসক শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়া বিয়ে নিয়ে নতুন এই অধ্যাদেশ জারি করেছেন। প্রসঙ্গত, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৯টি আমিরাতের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট।
ওই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, নতুন আইনের মধ্যে বিয়ে, বিচ্ছেন, ভরণপোষণ, সন্তানের যৌথ অভিভাবকত্ব, অভিভাকত্বের প্রমাণ এবং উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
বার্তা সংস্থা ডব্লিউএএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এই আইন আমিরাতের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অবস্থান সুদৃঢ় করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে। বার্তা সংস্থাটি জানিয়েছে, অমুসলিমদের পারিবারিক বিষয়ে এমন দেওয়ানি আইন বিশ্বে এটিই প্রথম।
এই অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে পরিবর্তন আনা হয়েছে সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রেও প্রচলিত আইনে। নতুন আইন অনুযায়ী, বাবা-মা দুজনকেই সন্তানের যৌথ অভিভাবকত্বের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ২০টি আর্টিকেল সমন্বয়ে গঠিত এই আইনে সিভিল ম্যারিজের ধারণা প্রবর্তন করা হয়েছে এবং একই সাথে সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব যে নিতে চায়, তাকেই দেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে।
এই আইন প্রসঙ্গে আবুধাবির বিচার বিভাগের সূত্র উল্লেখ করে দেশটির জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অমুসলিমদের মধ্যে ব্যক্তিসত্ত্বার বিরোধ মোকাবেলায় ‘একটি নমনীয় ও উন্নত আইনি প্রক্রিয়া’ প্রদানের লক্ষ্যেই নতুন এই আইনের উদ্দেশ্য।
আইনের প্রথম অধ্যায়ে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে নাগরিক বিবাহের ধারণা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে অমুসলিমদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের নিয়মকানুন, বিবাহবিচ্ছেদের পর স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং স্ত্রীর আর্থিক অধিকার মূল্যায়নের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এক্ষেত্রে বিয়ের বছর সংখ্যা, স্ত্রীর বয়স, স্বামী/স্ত্রীর প্রত্যেকের অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় আনা হবে; পাশাপাশি ওই সবকিছু যা বিচারক স্ত্রীর আর্থিক অধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনা করআ উচিত বলে মনে করেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে বলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য মূলত বিবাহবিচ্ছেদের পরে পরিবারের সংহতি রক্ষার জন্য। পাশাপাশি শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণও এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে।
চতুর্থ অধ্যায়ে উত্তরাধিকারসংক্রান্ত সমস্যা, অমুসলিমদের জন্য উইলের রেজিস্ট্রেশন এবং একজন বিদেশির উইল তৈরির অধিকার নিয়ে বলা হয়েছে। আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে অমুসলিম বিদেশিদের জন্য পিতৃত্বের প্রমাণবিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে।
সূত্র মতে, এমন বিষয় সম্পর্কিত মামলার বিচারের জন্য নতুন আদালতও স্থাপন করা হবে। আবুধাবিতে এই আদালত স্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। আরবির পাশাপাশি ইংরেজিও ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে আদালতে।
উল্লেখ্য, গত বছর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বেশ কিছু আইনে পরিবর্তন এনেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত; যা তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিল। নতুন ওইসব আইনে অবিবাহিত যুগলদের একসঙ্গে বসবাস, অ্যালকোহল বিধিনিষেধ শিথিলকরণ এবং তথাকথিত ‘অনার কিলিং’কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করাসহ বেশকিছু বিষয়ের উল্লেখ ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগ, পর্যটক এবং উৎপাদনশীল অভিবাসী আকর্ষণের উদ্দেশ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ধরনের আইনি সংস্কার অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
আরব আমিরাত বর্তমানে বৃহৎ এক বহুজাতিক দেশ৷ দেশটিতে ২০০-র বেশি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করছে৷ তাদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি৷ আমিরাতের স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ। সংখ্যায় যা ৬.৪ মিলিয়ন৷
এদিকে বিয়ের ব্যাপারে উৎসাহ হারাচ্ছে আমিরাতের স্থানীয় তরুণ সমাজ। বিয়ে আমিরাতে একটি ধর্মীয় আচার হিসেবে পরিচিত। দেশটির সংস্কৃতির অংশ৷ তাই দেশটির সরকার ১৯৭০ সাল থেকেই তরুণদের বিবাহে উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বরকে ৭০ হাজর দিরহাম বা ১৯ হাজার ডলার অনুদান দিয়ে আসছে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ