আফগানিস্তানে হাহাকার চলছে। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। তার ওপর আসছে তীব্র শীত, বাড়ছে শঙ্কা। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক এলাকা খরার কবলে পড়েছে। ফলে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে আফগানেরা।
তাদের এই ভয়াবহতা তুলে ধরেছে অনলাইন বিবিসি। এতে সাংবাদিক জন সিম্পসন লিখেছেন, রাজধানী কাবুল থেকে ৫০ মাইল পশ্চিমের ময়দান ওয়ারডক। সরকারিভাবে কিছু আটা দেয়া হচ্ছে সেখানকার একটি স্থানে। তাতে কয়েক শত মানুষের গাদাগাদি, ভিড়। এই আটা সরবরাহ দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। তা হাতের নাগালে পেতে মানুষের হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি। কিন্তু তাদেরকে শান্ত রেখেছে তালিবান সেনারা। কিন্তু কিছু মানুষকে বলে দেয়া হয়েছে, তারা এই সহায়তা পাওয়ার উপযুক্ত নয়। এসব মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মধ্যে। একজন প্রবীণ বললেন, শীত এসে গেছে। যদি রুটিরও ব্যবস্থা করতে না পারি, তাহলে কিভাবে এই শীত পাড় করবো জানি না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখের বেশি আফগানকে সাহায্য করতে হিমশিম খাচ্ছে ডব্লিউএফপি। এরপর যদি সামনের দিনগুলোতে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। শীতের সময় আবহাওয়া খারাপ হওয়ার যে আভাস বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, সেটা যদি হয় তাহলে বিপুল সংখ্যা মানুষ মারাত্মক ক্ষুধায় ভুগবে এবং সুদূরপ্রসারী দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
বিবিসির প্রতিবেদক জন সিম্পসন রোববার কাবুল সফরকালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলের সঙ্গে কথা বলেন।
ডেভিড বিসলে জানান, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি ততটাই খারাপ যতটা আপনি কল্পনা করতে পারেন। আসলে আমরা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটের দিকে তাকিয়ে আছি।
তিনি আরও বলেন, দেশটির ৯৫ ভাগ মানুষের পর্যাপ্ত খাবার নেই। এখন আমরা দেখছি দেশটির ২৩ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরের ছয়মাস বিপর্যয়কর হতে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে দুনিয়াতেই নরক নেমে আসতে যাচ্ছে।
তালিবান আফগানিস্তান দখল করতেই দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সামনের মাস থেকেই চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে চলেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আগাম সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে বলে মনে করছে ডাব্লিউএফপি।
সংস্থাটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডেভিড বেসলি জানিয়েছেন, খাদ্য কর্মসূচির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তান। তালিবান সরকারের অনিয়ন্ত্রিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিই দেশটিকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তালিবানরা সাধারণ নাগরিকদের বিন্দুমাত্র পরিষেবা দিতেও ব্যর্থ। জিনিসের দাম বেশিরভাগ মানুষেরই নাগালের বাইরে। এক বেলা খেতে পর্যন্ত পারছে না অর্ধেকের বেশি মানুষ। ইতোমধ্যেই বহু শিশু অনাহারে প্রাণ হারিয়েছে। তালিবানকে মদদ দিলেও আফগানিস্তানকে এখন আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই পাকিস্তানের।
আফগানিস্তানে বেশিরভাগ মানুষের হাতে পয়সা নেই। এরমধ্যে চলছে লুটপাট। খোদ তালিবান সেনারাও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি লুট করছে। সাধারণ মানুষের আয় রোজগারের বেশিরভাগ রাস্তাই বন্ধ। বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তানে। ইতোমধ্যেই ৯৩ হাজারেরও বেশি আফগান আশ্রয় নিয়েছে পাকিস্তানে। তোরখাম সীমান্তে মানুষের ঢল সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী। অথচ তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার আগে বেশ ভালোই ছিল সেখানকার মানুষ।
আফগানিস্তানে বেশিরভাগ মানুষের হাতে পয়সা নেই। এরমধ্যে চলছে লুটপাট। খোদ তালিবান সেনারাও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি লুট করছে। সাধারণ মানুষের আয় রোজগারের বেশিরভাগ রাস্তাই বন্ধ। বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তানে।
গত আগস্টে তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের আগে দেশটিতে মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার আসন্ন শীতকালীন সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহায়তা পাঠাবে। কিন্তু গনির সরকারের পতন আর তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো আফগানিস্তানে সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। দেশগুলো মনে করছে, এখন যদি সহায়তা পাঠানো হয়, তাহলে সেটা তালিবানের হাতে পড়বে। এতে কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং লাভবান হবে তালিবান। সেই কারণে সাধারণ আফগানরা নানা ধরনের সংকটের মধ্যে দিন অতিবাহিত করলেও তাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে না দেশগুলো।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য। দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, সেই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আফগানদের পাশে এসে দাঁড়ানো। মারাত্মক অনাহারের মুখে থাকা লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের জীবন বাঁচানো। এ জন্য উন্নত দেশ ও ধনকুবেরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ডব্লিউএফপির বিসলেই। তিনি বলেছেন, বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে ধনকুবেরদের প্রতি আহ্বান: অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে আপনার ছোট্ট মেয়ে ও ছোট্ট ছেলে, আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানির মৃত্যুর কথা আপনারা কল্পনা করুন। আপনাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কিছু করা উচিত। ৪০০ ট্রিলিয়ন সম্পদের আজকের এই দুনিয়ায় এভাবে মানুষের মৃত্যু আমাদের জন্য লজ্জার।’
বিসলেই বলেছেন, ‘আমরা যদি অনাহারে কোনো শিশুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিই, সেটা হবে আমাদের জন্য চরম লজ্জার।’
তালিবান ক্ষমতা গ্রহণের পর অনেক লোক চাকরি হারিয়ে বেকার। একমাত্র উপার্জনের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক পরিবারের খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। শহরের পাশাপাশি গ্রামের চিত্রই একই।
জাতিসংঘের ডাব্লিউএফপির কার্যনির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলির কথায়, ‘নিজেদের সম্পত্তি বিক্রি করেও আফগান নাগরিকরা নিজেদের খাবার ব্যবস্থা করতে পারছে না। তাই মনে হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানবিক সংকট এখন আফগানিস্তানেই।’
জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংগঠনের ডিরেক্টর কিউ ডংয়ুর মতে, ‘শীতকালে আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলের সঙ্গে যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তাই এখনই সব জায়গায় খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক করা জরুরি। অন্যথায় প্রবল শীতে ক্ষুধার জ্বালা মারাত্মক চেহারা নেবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে। মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫২
আপনার মতামত জানানঃ