গরু চোর সন্দেহে ভারতের ত্রিপুরায় এক বাংলাদেশিকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের বরাত দিয়ে গতকাল শনিবার এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি দূর্গা পূজায় বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর হামলা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে আছে ত্রিপুরা। সেখানকার মুসলিমদের উপর কয়েকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ত্রিপুরার সিপাহিজলা জেলার সোনামুড়া মহকুমার অন্তর্গত কমল নগর গ্রামে। এই এলাকা বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া। শনিবার ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
এনডিটিভির ওই প্রতিবেদনে জানানো হয় শুক্রবার গভীর রাতে বাংলাদেশ থেকে তিনজন গরু চোরাকারবারী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করেন। এরপর ত্রিপুরায় একটি বাড়িতে তারা গরু চুরি করতে গেলে মালিক প্রতিবেশীদের সহায়তায় তাদের ধরে ফেলেন।
সূত্র মতে, শুক্রবার রাতে ওই ৩ গরু চোরাকারবারি বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরার ওই গ্রামের লিটন পালের বাড়িতে গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে।
এ সময় সন্দেহভাজন তিনজনের মধ্যে দুইজন পালাতে সক্ষম হয়। তবে একজন পালাতে পারেনি। এরপর স্থানীয়দের একটি বিক্ষুব্ধ দল তাকে পিটিয়ে হত্যা করে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানায়।
শনিবার সকালে নিহতের পকেটে পুলিশ একটি মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশি টাকা পায়। তবে নিহতের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। তবে গরু চোরেরা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার বাসিন্দা বলে জানা যাচ্ছে।
স্থানীয়রা বলেছেন, ওই তিন বাংলাদেশি কমল নগর গ্রামের বাসিন্দা লিটনের বাড়িতে ঢুকে গরু চুরির চেষ্টা করেন। এ সময় লিটন পল বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে কুপিয়ে তার কান কেটে দেন তারা।
বাংলাদেশি গরু চোরেরা কমলানগরের বাসিন্দা মানিক পালের উপর হামলা করেছিল। এরপর মানিক পাল আহত হয়ে পড়েন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আগরতলার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
ভারতের বর্বরতার সাক্ষর সীমান্ত হত্যা
উল্লেখ্য, ত্রিপুরা সহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিভিন্ন জায়গা থেকেই বারবার অনুপ্রবেশ এবং চোরাচালানের অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক সময় সীমান্ত রক্ষাবাহিনীর সঙ্গে তারা সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে। বিএসএফ-এর গুলিতে অনেক চোরাচালানকারী প্রাণও হারায়।
তবুও তারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বারবার ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে, এটা সন্দেহজনক মনে করছেন অনেকেই। এর আগে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ডোনা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। গতবুধবার সকালে তাদের নিহত হওয়ার তথ্য জানান স্থানীয়রা।
সূত্র মতে, সীমান্তের ৩১ নম্বর পিলারের কাছে ওই গুলির ঘটনা ঘটে। নিহত দু’জন হলেন কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ গ্রামের নকিব আলীর ছেলে আসকর ও হান্নান মিয়ার ছেলে আরিফ। তবে ঠিক কখন তারা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এ বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে তারা গুলির শব্দ শুনেছেন। সকালে দুই ব্যক্তির লাশ সীমান্তের ওপারে ছড়ায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের অন্যতম সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সীমান্তে গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু হয়ছে। আহত হয়েছেন ৪ জন এবং ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তিনজনকে।
জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সীমান্তে হত্যা এবং নির্যাতনের আরও ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে মোট ৪২ জন বাংলাদেশি নিহত এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আরও ৬ জনের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা।
যদিও বাংলাদেশ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের অঙ্গীকার রয়েছে। অথচ মানবাধিকার সংস্থার মতে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে গুলি বা নির্যাতন করে হত্যা করেছে বিএসএফ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রেকর্ড মতে, ২০১৯ সালে বিএসএফ’র হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৪৩ জন বাংলাদেশির। যাদের মধ্যে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে।
সীমান্তে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার বছরভিত্তিক সরকারি হিসাব মতে, ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪ জন করে, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ জন।
ত্রিপুরায় সাম্প্রদায়িক উত্তাপ
বাংলাদেশে হিন্দু মরলে, ভারতে মরে মুসলিম। ধর্মীয় ভেদনীতির এই খেলায় দুই দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি আজ কাঠগড়ায়। দুই দেশেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ধর্ম। গোদি জেঁকে বসার ছকে ধর্ম আজ ভাড়াটে খুনি।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার জের ধরে সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে টানা কয়েকদিন ধরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
প্রসঙ্গত, ত্রিপুরার তিন দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। আর একদিকে ছোট্ট একটি অংশ যুক্ত আসামের সঙ্গে। রাজ্যের মোট ৪২ লাখ জনসংখ্যার ৯ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম। বাকি জনসংখ্যার অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তু।
সূত্র মতে, সীমান্তবর্তী পানিসাগর এলাকায় সহিংস ঘটনার পর রাজ্যের ১৫০টি মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করে পুলিশ। স্থানীয়রা জানান, “মুসলিমরা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন”।
পুলিশ ও সংখ্যালঘু নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে ত্রিপুরার বিভিন্ন অংশে কমপক্ষে ১০টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। যদিও এই তথ্য নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে সব ক্ষেত্রেই মসজিদ এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর একাধিক আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে।
এমনকি সহিংস ঘটনার পর উপদ্রুত এলাকায় জমায়েতের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সেখানে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ভিইএইচপির তাণ্ডবের দিনেই মুসলিম নারীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া পানিসাগরের রাওবাজার এলাকার মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল। থানায় যে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল তাতে অবশ্য নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ থাকলেও, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়নি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ