গোটা বিশ্বে গত ২৯ বছরে হত্যা করা হয়েছে এক হাজার ৪০০ জন সাংবাদিককে। হেগের একটি ট্রাইবুনাল কয়েকটি ঘটনার তদন্ত করছে। এদিকে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট নামক সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশে ১৯৯২ সাল হতে এ পর্যন্ত ২১জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তবে এই সংখ্যা নিয়ে আছে বিতর্ক। এক হিসেবে বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে ২৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন; আহত হয়েছেন ৫৬১ জন (প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি)। আরেকটি হিসেবে বলা হচ্ছে, ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
মহামারিতে সাংবাদিক হত্যা
এদিকে, করোনা মহামারির মধ্যে বেড়েছে সাংবাদিক হত্যার প্রবণতা। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে নিহত হয়েছেন মোট ৫০ জন সাংবাদিক৷ সবারই মৃত্যুর কারণ সাংবাদিকতা৷
২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মৃত্যু হয় তাদের৷ ২০১৯ সালে সংখ্যাটা ছিল ৫৩৷ তবে মনে রাখা দরকার, ২০২০ সাল জুড়ে করোনার কারণে সাংবাদিকরা মাঠ পর্যায়ে তেমন কাজই করতে পারেননি৷
২০১৬ সালে নিহত সাংবাদিকদের শতকরা ৫৮ ভাগই ছিল যুদ্ধ চলছে এমন দেশগুলোতে৷ ২০২০ সালে সেরকম দেশে সাংবাদিক হত্যার হার কমে হয়ে যায় ৩২ ভাগ৷ অর্থাৎ, যুদ্ধের লেশমাত্র নেই এমন দেশগুলোতেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয় বাকি ৬৮ ভাগ সাংবাদিককে৷
২০২০ সালে যে ৫০ জন সংবাদকর্মীকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়, তাদের ৮৪ ভাগই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার৷ ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশ করা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বে সাংবাদিকদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার প্রবণতাও বেড়েছে, কারণ, ২০১৯ সালে এমন হত্যার ঘটনা ছিল ৬৩ শতাংশ৷
২০২০ সালে মোট ৩৮৭ জান সাংবাদিককে বিভিন্ন দেশে গ্রেপ্তার বা জিম্মি করা হয়৷ ৩৮৭ জনের মধ্যে নিখোঁজও রয়েছেন কয়েকজন৷
২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি আট জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন মেক্সিকোতে৷ তারপরই রয়েছে ভারত, ফিলিপাইন্স আর হন্ডুরাস৷ ভারতে মারা গেছেন চার জন আর ফিলিপাইন্স এবং হন্ডুরাসে তিন জন করে৷
রিপোটার্স উইদাউট বডার্স-এর মেক্সিকো প্রতিনিধি ব্যাবলিনা ফ্লোরেস বলেছেন, ”হত্যাকারীরা একটি পরিবারকে শেষ করে দিল। কিন্তু তারা ধরা পড়ল না। ৯০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে হত্যাকারীরা ধরা পড়ে না।”
বাংলাদেশে পরিস্থিতি
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একজন সাংবাদিক হত্যার শিকার হন ও অপহৃত হয়েছেন দুইজন সাংবাদিক। এইসময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ মামলায় আসামি ৪৮ সাংবাদিক, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে বিভিন্ন হয়রানিমূলক ২৪ মামলার আসামি আরও ৮৯ সাংবাদিক। এছাড়াও ১৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির ৬টি মামলা হয়েছে বলে রেকর্ড করেছে আর্টিকেল নাইনটিন।
আর্টিকেল নাইনটিন’র রেকর্ড বলছে: আর্টিকেল নাইনটিন ২০২০ সালে বাংলাদেশে হামলা-মামলা, হয়রানিসহ মতপ্রকাশজনিত অধিকার লঙ্ঘনের ৬৩১টি ঘটনা রেকর্ড করে। অধিকার লঙ্ঘনের ৭৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা ৪৫৪টি ঘটনাই আইনি হয়রানির। এসময়ে মতপ্রকাশজনিত কারণে শারীরিক হামলার ১০৩টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
রাজধানী ঢাকার বাইরে মফস্বল ও গ্রাম এলাকায় মতপ্রকাশজনিত অধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা বেশি, যা মোট ঘটনার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে এই হার ২২ দশমিক ২২ শতাংশ।
অন্যদিকে, ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) একজন সাংবাদিক হত্যার শিকার হন ও অপহৃত হন দুইজন সাংবাদিক। এই সময়ে শারীরিক আঘাত ও লাঞ্ছনার ১৩৭টি ঘটনায় ভুক্তভোগী ২৪১ জন সাংবাদিক। ৫৫টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৫৩ সাংবাদিককে, যাদের মধ্যে ১৬ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হয়।
মামলাগুলোর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ মামলায় আসামি ৪৮ সাংবাদিক, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে বিভিন্ন হয়রানিমূলক ২৪ মামলার আসামি আরও ৮৯ সাংবাদিক। এছাড়াও ১৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানির ৬টি মামলা রেকর্ড করেছে আর্টিকেল নাইনটিন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রক্তের দাগ শুকিয়ে যাবে, কবরে ঘাস গজাবে, মানুষও সাংবাদিকতা পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত মানুষদের ভুলে যাবে। যদি সংবাদপত্রের কাগজগুলো সাদাই থাকত, টেলিভিশনের পর্দা দিনরাত ঝিরঝির করত আর অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখা থাকত ‘৪০৪ সিস্টেম এরর’— তাহলে হয়তো সাংবাদিকতার জরুরত মালুম হতো অনেকের। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনকে তখন এতটা ‘স্বাভাবিক’ মনে হতো না। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে সে উপায়ও নেই গণমাধ্যমের। একদল সাংবাদিক তবু পেশাগত পবিত্রতা মাথায় নিয়ে পবিত্র প্রাণীর মতো অপঘাতের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যান। পরাজয় জেনেও যিনি লড়াই করে যান, তাকেই বলে সংশপ্তক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন সংশপ্তক পর্ব পার করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ