কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে ঘটে গিয়েছিল এক দুর্বিষহ ঘটনা। বাংলাদেশের কুমিল্লার দুর্গামণ্ডপে কোরান রাখাকে কেন্দ্র করে দেশের একাধিক দুর্গামণ্ডপে ধার্মিক উন্মাদরা হামলা চালিয়েছিল। একের পর হিন্দু এলাকায় চলেছিল তাণ্ডব। এই অতর্কিত হামলায় প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন। বহু হিন্দুর বাড়ি আগুনে পুড়ে হয়ে গিয়েছে ছাই। আমেরিকা থেকে শুরু করে জাতিসংঘও এই বর্বরোচিত হামলার নিন্দা করেছে।
বাংলাদেশে মন্দির ভাঙচুর, হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানোর খবরে উত্তপ্ত ভারত। তার আঁচ এসে লাগে ত্রিপুরায়। সম্প্রতি ত্রিপুরার কয়েকটি মসজিদ এবং মুসলিমদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। রাজ্যজুড়ে সেই হামলায় অন্তত ৬টি মসজিদ এবং মুসলিমদের এক ডজনেরও বেশি বাড়িঘর-দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়।
এ ঘটনার এক সপ্তাহ যেতে না যেতে আবারও আক্রান্ত হয়েছে মুসলিমদের স্থাপনা এবং দোকানপাট। মঙ্গলবার সন্ধ্যা দিকে ত্রিপুরার একটি মসজিদে ভাঙচুর এবং মুসলিমদের দুটি দোকানে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। উত্তর ত্রিপুরার চামটিল্লা এলাকায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ত্রিপুরা পুলিশ।
দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, ত্রিপুরা পুলিশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বার্তা পোস্ট করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ওই এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে আশ্বস্ত করেছে পুলিশ।
বাংলাদেশের ঘটনার জেরে গত ২১ অক্টোবর ত্রিপুরার গোমতি জেলার উদয়পুরে এক বিশাল মিছিলের আয়োজন করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং হিন্দু জাগরণ মঞ্চ। সেই মিছিলকে কেন্দ্র করে প্রথম উত্তেজনা ছড়ায়। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগোনোর চেষ্টা করলে প্রশাসনের সঙ্গে কার্যত খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায় আন্দোলনকারীদের। পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ। পুলিশও পাল্টা লাঠিচার্জ করে। ঘটনায় দুইপক্ষেরই কয়েকজন আহত হয়।
পুলিশের বক্তব্য, ওই এলাকায় মুসলিমদের বসবাস থাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল আটকানো হয়েছিল। যাতে উত্তেজনা ছড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু আরএসএস নেতা অভিজিৎ চক্রবর্তীর বক্তব্য, আগেই পুলিশের কাছ থেকে মিছিলের অনুমতি নিয়ে রাখা হয়েছিল।
এদিকে এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই দিকে দিকে গুজব ছড়াতে শুরু করে। উনকোটিতে এক দেবতার মূর্তি পাহাড়ের উপর ফেলে রেখে আসা হয়েছে বলে গুজব ছড়ায়। উনকোটির পুলিশ সুপার রতি রঞ্জন দেবনাথ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, যেভাবে গত কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে পাহাড়ের উপর ওই জায়গায় কারো পক্ষে মূর্তি রেখে আসা সম্ভব নয়। বিষয়টি গুজব বলেই তিনি দাবি করেছেন।
ত্রিপুরায় মসজিদে অগ্নিসংযোগ এবং মুসলিমদের বাড়িঘরে ভাঙচুরের ঘটনার এক সপ্তাহ যেতে না যেতে আবারও আক্রান্ত হয়েছে মুসলিমদের স্থাপনা এবং দোকানপাট।
ত্রিপুরায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি র্যালির সময় সেখানে একটি মসজিদ ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু দোকানপাটে। এসব দোকানের মালিক মুসলিমরা।
ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআই এক রিপোর্টে বলেছে, ত্রিপুরায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি র্যালির সময় সেখানে একটি মসজিদ ভাঙচুর করা হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বেশ কিছু দোকানপাটে। এসব দোকানের মালিক মুসলিমরা। বিরোধী দল সিপিআই(এম) এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নন বিজেপি মুখপাত্র।
পিটিআই আরো লিখেছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে উত্তর ত্রিপুরা জেলার চামতিল্লা এলাকায় একটি র্যালি বের করে। ওই জেলার এসপি ভানুপদ চক্রবর্তী বলেছেন, এ সময় মসজিদে ভাঙচুর করা হয়েছে। দুটি দোকানে আগুন দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এ ছাড়া রোয়াবাজারে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের তিনটি বাড়ি ও কয়েকটি দোকানে লুটপাট করা হয়েছে। ভানুপদ চক্রবর্তী আরো বলেন, চামতিল্লা এলাকায় র্যালি করার সময় একদল লোক ওই মসজিদে ইটপাথর নিক্ষেপ করে এবং এর একটি দরজার ক্ষতি করে। এর পরপরই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে তারা। আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, এ ঘটনায় একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বিরোধী সিপিআই(এম)। বামপন্থি এই দলটি বলেছে, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে সক্রিয় আছে দুর্বৃত্তদের একটি গ্রুপ। সব পক্ষের প্রতি শান্তি বজায় রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই (এম)। তারা এক বিবৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছে।
অন্যদিকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত নন বলে জানিয়েছেন বিজেপির মুখপাত্র নবেন্দু ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেছেন, যদি এমন কিছু ঘটে থাকে তাহলে পুলিশের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ওদিকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার পর ত্রিপুরায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে রাজ্য সরকার। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তা আরো কড়াকড়ি করা হয়েছে। এই সীমান্ত বরাবর ত্রিপুরার যেসব জেলা রয়েছে, তার এসপিদেরকে অতিরিক্ত দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কোনো অনুপ্রবেশের চেষ্টা ভণ্ডুল করতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে সতর্ক রাখা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে কোথাও সাম্প্রদায়িক হামলা হলে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় কারও মনে হতে পারে যে বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়াচ্ছে ভারতের সরকার, দূতাবাস। কিন্তু কার্যত তাদের ভূমিকা এ দেশে হিন্দু পরিচয়ের মানুষদের রীতিমতো অপমানিত করে, তাদের নিরাপত্তাহীনতাও বাড়ায়। এতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান তো হয়ই না, বরং এ দেশে যারা সারাক্ষণ দাবি করে ‘হিন্দুরা ভারতের লোক’, তাদের গলার জোর বাড়ে।
ভারতের বিশেষজ্ঞরাই বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন ভারতের বিজেপি সরকারের সে দেশে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে সাহায্য করে বলেই এ নিয়ে তাদের এত উৎসাহ। তার মানে, বাংলাদেশে যারা ইসলামের নামে মন্দির বা হিন্দুবাড়িতে হামলা করছে, তারা প্রকারান্তরে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকেই সহায়তা করছে, ভারতের মুসলমানদের অবস্থা আরও নাজুক করছে। মূলত দুই দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সুবিধা আদায়ের সংস্কৃতিই দেশ দুটিতে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ভেদনীতির চিরায়ত এক ভীত গড়ে তুলেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ