সম্প্রতি সরকারের হাই কমান্ড থেকে অর্থপাচার ঠেকানো ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে জোরালো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত এবং এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে তাগিদে দেয়ার পাশাপাশি নেতারা রাজনোইতিক মঞ্চেও এ বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতি রাখছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে এসেই পাচার প্রতিরোধ ও অর্থ উদ্ধারের সব পদক্ষেপ ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে। আমলাতন্ত্র তথা সরকারি কর্মচারীরা অর্থ লোপাটে ও পাচারে জড়িত থাকায় এ সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
আমলাদের প্রভাবের কারণে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণ করা যাচ্ছে না বলে তথ্য মিলেছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার কুপ্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমলারা যদি অর্থ পাচারে জড়িত থাকেন, তাহলে তারা অর্থ পাচার প্রতিরোধী আইন প্রণয়নে নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তাতে করে ওই আইনে ফাক-ফোঁকর থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ আমলাদের হাত হয়েই এসব আইন ও এ বিষয়ক বিধি-বিধানের প্রস্তাবনাগুলো তৈরি হয়। আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত না রাখতে পারলে কিংবা আমলাদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি না করা গেলে সরকারি ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে যাবে।
অর্থপাচার বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী অর্থ পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্যানুযায়ী, গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার, প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের যা ঋণ, তার চেয়েও বেশি। সূত্রমতে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এ যাবৎ বৈদেশিক ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা প্রায়। অর্থাৎ গত ৭ বছরে পাচার হওয়া টাকা দিয়ে দেশের সব ঋণ শোধ করে দেয়া যেত।
পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে থাকলে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হতো, পাল্টে যেত দেশের চেহারা। কিন্তু কোনোভাবেই অর্থ পাচার থামছে না। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সরকার দফায় দফায় নানা উদ্যোগের ঘোষণা দিলেও এখনো এসব অর্থের এক টাকাও তারা উদ্ধার করতে পারেনি। অথচ প্রতি মাসেই এ নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে পাচারের অর্থ উদ্ধার করা হবে, সেই কৌশলই নাকি এখনো ঠিক করতে পারেনি সরকারের দায়িত্বরতরা। ফলে দুর্নীতি দমনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সর্বশেষ মাসিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেও এ নিয়ে আলাপ হয়েছে বলে জানা গেছে। গত মাসের ওই বৈঠকেও সুইস ব্যাংকসহ অনেক দেশে অর্থ পাচারের তথ্য উঠে আসে। এই অর্থ উদ্ধারে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে আর্থিক ও কর সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়ার পক্ষে মত দেয় অর্থ বিভাগ। বৈঠকে বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে যেসব কৌশল অনুসরণ করে, বাংলাদেশও তা অনুসরণ করতে পারে। যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত চুক্তি করতে হবে। প্রয়োজনে কর তথ্যবিনিময় চুক্তিও করতে হবে। এ ব্যাপারে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দুদক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জননিরাপত্তা বিভাগ, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়কে (আরজেএসসি) বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে মতামত দিতে বলা হয়েছে।
[soliloquy id=”2196″]
অর্থপাচারের অভিযোগ অনেক পুরনো হলেও এখনো যে আমলারা এক্ষেত্রে করণীয় কৌশল নির্ধারণ করতে পারছে না, এটা কেবলই কর্মদক্ষতার সমস্যা নয়। সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। একই সঙ্গে প্রাথমিক যে তথ্য তারা পেয়েছেন তাতে তারা দেখেছেন যে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি। তিনি উল্লেখ করেছেন, আঠাশটি ঘটনার তথ্য তারা পেয়েছেন যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি। সরকারী কর্মচারুরা যদি অর্থ পাচারে যুক্ত থাকে, তাহলে মন্ত্রণালয়ের এক্ষেত্রে কর্মকৌশল নির্ধারণে গাফিলতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামানও গণমাধ্যমকে বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে এতদিন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচারের যে অভিযোগ করা হচ্ছিলো, সেটি সত্য। সরকারি কর্মকর্তারাও অনেকে অর্থ পাচারে জড়িত। তারা বিদেশে যাতায়াত করেন। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে পড়াশোনা বা চিকিৎসা সহ নানা কারণে যেতে পারেন। পাচারের সেটা একটা অন্যতম মাধ্যম।
দুদকে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, এ পর্যন্ত ৫০ অর্থ পাচারকারীর সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে ২৮ জনের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। পাচারকারীদের তথ্য পেতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ ১৮টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবার আগে আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ আমলাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু সরকার আমলাদের গ্রেফতারে বাধা সৃষ্টি করেছে। সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী বিশেষ ছাড় ও সুবিধা পাচ্ছে আমলারা। এ কারণে আমলাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। অর্থপাচার প্রতিরোধে ও পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করতে হলে সব ধরনের ক্ষমতাধরদের আইনের আওতায় আনার মানসিকতা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
মিই/আরা/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ