তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়! আফগানিস্তানের তেমনই এক চিত্র ফুটে উঠেছে পর পর দুই জুম্মাবারে শিয়া মসজিদে বোমা হামলায়।
গত শুক্রবার উত্তরাঞ্চলীয় শহর কুন্দুজের একটি শিয়া মসজিদে শুক্রবারের নামাজের সময় আত্মঘাতী হামলা চালানো হয়েছি যাতে অন্তত ৮০ জন নিহত হয়। পরে সুন্নি জঙ্গি সংগঠন আইএস-কে ওই হামলার দায় স্বীকার করে। আফগানিস্তানে যতগুলো জিহাদি গ্রুপ তৎপর রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে চরম এই আইএস-কে। এমনকি তালিবানও যেখানে কট্টরপন্থী হিসেবে বিবেচিত হয় সেখানে আইএস-কে তালিবান শাসনেরও বিরোধিতা করছে।
গত শুক্রবারের ঘা শুকাতে-না-শুকাতেই আবারও আফগানিস্তানের এক শিয়া মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেটাও আজ শুক্রবার জুম্মার দিনে। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৩ জন। আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৭৩ জন। শুক্রবার দেশটির কান্দাহারের বিবি ফাতেমা মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার সময় এই হামলা চালানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তিনজন আত্মঘাতী হামলাকারী এই হামলা চালিয়েছে। এরমধ্যে একজন মসজিদের মধ্যে প্রবেশের পর বিস্ফোরণ ঘটায় আর অপরজন মসজিদের বাইরে বিস্ফোরণ ঘটায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা ফুটেজ ও ছবিতে দেখা যাচ্ছে মসজিদের মেঝেতে ব্যাপক মরদেহ পড়ে আছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
বিস্ফোরণে মসজিদের জানালার কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, মেঝেতে মানুষজন পড়ে আছে এবং অন্যান্য মুসল্লিরা তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই হামলাটিও আত্মঘাতী হামলা ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মসজিদের প্রধান ফটকের কাছে তিনটি বিস্ফোরণ হয়েছে। বিস্ফোরণের সময় মসজিদটি মানুষে পূর্ণ ছিল। এর পরপরই সেখানে ১৫টি অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যায়।
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এখন পর্যন্ত এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। তবে তালিবান কর্তৃপক্ষের ধারণা, এই হামলার জন্য দায়ী আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের আফগানিস্তান শাখা ‘আইএসকে’।
বৃটিশ গণমাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বর্তমানে তালিবান সদস্যরা মসজিদটির আশেপাশে পাহাড়া দিচ্ছে। গত ১৩ই আগস্ট এই কান্দাহার শহর দখল করেছিল তারা। এর দুদিন বাদেই কাবুলের দখল নেয় তালিবান। এরপর থেকে ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় একটি গ্রুপ আইএসকে’র সাথে তালিবানের দ্বন্দ্ব প্রকট রূপ ধারণ করতে থাকে। এরইমধ্যে একাধিক হামলা চালিয়েছে আইএসকে। যদিও অন্যান্য সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলোও প্রায়ই আফগানিস্তানের শিয়াদের টার্গেট করে দশকের পর দশক ধরে হামলা চালিয়ে আসছে।
বর্তমানে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে ২০ শতাংশ শিয়া সম্প্রদায় হাজারা সংখ্যালঘু। হাজারারা চেঙ্গিস খানের বংশধর হিসেবে পরিচিত। দিনের পর দিন এ সম্প্রদায়ের মানুষ পশতুনদের কাছে বঞ্চনা ও নিগৃহের শিকার হচ্ছে।
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
বেসামরিক সরকার হাজারাদের কথা শোনার চেষ্টা করলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে জঙ্গিদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত হয় হাজারারা। তালিবান থেকে শুরু করে যেকোনো সুন্নি উগ্রবাদীরা হাজারাদের মুসলমান মনে করে না।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তালিবান কমান্ডার মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ সমবেত সুন্নি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘হাজারারা মুসলিম নয়, তাদের হত্যা কর।’ এরপর তাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলতে থাকে। তালিবান সরকারের সময় হাজারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা-নির্যাতনের ভয়ে অনেক হাজারা শিয়াপ্রধান দেশ ইরানে পালিয়ে যায়। আর যারা মাটির মায়া ছাড়তে না পেরে থেকে যায়, তাদের ভাগ্যে জোটে নির্মম অত্যাচার। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফে ষড়যন্ত্র করে কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। তালিবান ও আল-কায়েদার জঙ্গিরা সুযোগ পেলে হাজারাদের রক্তে হাত রাঙাতে দ্বিধা করে না।
বর্তমানে হাজারাদের নতুন শত্রু আইএস। পথে, বাসে, প্রতিষ্ঠানে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে হামলা চালাচ্ছে তারা। চারদিক থেকে নির্যাতনের শিকার হাজারা সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হামলা তালিবান সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। বিদেশী বাহিনী চলে যাওয়ার পর গত আগস্টেই তারা ক্ষমতা বুঝে নেয়। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তালিবান সরকার-সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বেশ কয়েকজন আইএস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো অনেক সন্দেহভাজনকে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ করা হচ্ছে না।
তালিবানরা এবার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আগের চেয়ে শান্ত হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন অনেক আফগান নাগরিক। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তালিবান সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান বা আইএস-কে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২২
আপনার মতামত জানানঃ