বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে জাপানে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জাপানের সংবাদমাধ্যমগুলোও প্রতিদিন করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বিষয়ক সংবাদ পরিবেশন করে, তবে এর পাশাপাশি প্রতিদিন দেশে কতসংখ্যক আত্মহত্যা হলো— সেই তথ্যও জানাতে হয় তাদের।
মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াল তাণ্ডবের মাঝেই পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপানে শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে শিশুদের আত্মহত্যার সংখ্যা এতোটাই বেড়েছে যে— গেল চার দশকের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে জাপানি গণমাধ্যম তথ্যটি জানিয়েছে বলে বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) নিশ্চিত করেছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
জাপানে আত্মহত্যার হার এমনিতেই বেশি। করোনার কারণে শিশুদের মাঝেও বেড়েছে এই হার। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপে দেখা যায়, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪১৫ জন শিশু শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
বৃহস্পতিবার জাপানের সংবাদমাধ্যম আশাহি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, করোনা মহামারির মধ্যে আত্মহত্যা করা শিশু শিক্ষার্থীদের এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০০ জন বেশি। ১৯৭৪ সাল থেকেও সর্বোচ্চ। ১৯৭৪ সাল থেকে জাপানে শিশু শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার রেকর্ড রাখা হয় দেশটিতে।
এনএইচকে জানিয়েছে, জাপানের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, হয়রানি, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতি বছর জরিপ চালায় দেশটির সরকার। গত বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে এ সংক্রান্ত সবশেষ প্রতিবেদন।
জরিপে দেখা যায়, ২০২০ শিক্ষাবর্ষে জাপানে এলিমেন্টারি থেকে হাইস্কুল পড়ুয়া অন্তত ৪১৫ শিক্ষার্থী নিজের প্রাণ নিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০০ জন বেশি। এই শিক্ষাবর্ষে জাপানে এলিমেন্টারি স্কুলের সাতজন, জুনিয়র হাইস্কুলের ১০৩ জন ও সিনিয়র হাইস্কুলের ৩০৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
বেড়েছে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। করোনাকালে দেশটিতে এলিমেন্টারি ও জুনিয়র হাইস্কুলগুলোর প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
রয়টার্স বলছে, জাপানে মানুষের আত্মহত্যা প্রবণতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দেশটির অনেক মানুষ যেকোনো ধরনের লজ্জা বা অসম্মানজনক পরিস্থিতি এড়াতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়াকে উত্তম মনে করে। জাপানিদের আত্মহত্যার হার জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষে ছিল।
তবে এই আত্মহত্যার সংখ্যা গত ১৫ বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছিল। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে টানা ১০ বছর আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল নিম্নমুখী। তবে বৈশ্বিক মহামারি শুরুর পর জাপানে ফের আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মহামারির মধ্যে আবেগ ও আর্থিক চাপের কারণে জাপানি নারীদের মধ্যেও বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। তবে পুরুষেরাও রয়েছেন এই তালিকায়, যদিও এই সংখ্যা নারীদের তুলনায় কম।
জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গত ৩০ দিনে জাপানে রেকর্ড ১ লাখ ৯৬ হাজার ১২৭ শিশু অনুপস্থিত রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকেকে বলেন, করোনার কারণে স্কুল ও পারিবারিক পরিবেশে বড় পরিবর্তন এসেছে, যা শিশুদের আচরণে প্রভাব ফেলছে।
জাপানি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষার্থী বিষয়ক বিভাগের প্রধান ইগুচি আরিচিকা বলেছেন, জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, মহামারিজনিত কারণে স্কুল ও গৃহস্থালী পরিবেশের পরিবর্তন শিশুদের আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তাদের আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি খুবই দুঃখজনক।
তিনি জানান, শিশুদের সহযোগিতা চাওয়ায় উৎসাহিত করতে এবং যারা স্কুলে যেতে পারছে না তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কাজ করছে জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। কয়েক দশক ধরে তা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে সেগুলোর ইতিবাচক ফলাফলও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মহামারি দেশটিতে আত্মহত্যার যে চিত্র তুলে ধরেছে তাতে বিগত সব হিসেবে ওলট-পালট হয়ে গেছে।
রোগের মহামারিতে কেবল শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে না, মানসিক স্বাস্থ্য সংকটও সৃষ্টি হয়। করোনা মহামারির ফলে বিশ্বজুড়ে বেকারের সংখ্যা এবং মানসিক অসুস্থতা বেড়েছে। জাপানে বেড়েছে আত্মহত্যা। করোনার জন্য বিশ্বজুড়ে যা ঘটেছে জাপানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে।
জাপানের টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক মিচিকো উয়েদা আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি জানিয়েছেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় জাপানে করোনার প্রভাব কম পড়েছে। এরপরও এখানে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছেই।
জাপানে আত্মহত্যার কারণগুলো বেশ জটিল। সেখানে মানসিক চাপ বাড়ার কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অন্যতম। জাপানের মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে যখন মানুষকে বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়, তখন বুঝতে হবে হয় সেখানে কাজ করার মানুষের ঘাটতি আছে, অথবা পুঁজিপতিরা দীর্ঘ সময় কাজ করাতে বাধ্য করে যাতে মুনাফা বেশি হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, লোকজন কোভিড-১৯ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু অনেক মানুষ তাদের কাজ হারিয়ে, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো আশা দেখছেন না, তারা আত্মহত্যা করছেন। জাপানে আত্মহত্যার উচ্চহারের নানা জটিল কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্কুলের চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো নানা বিষয় রয়েছে। করোনার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৭
আপনার মতামত জানানঃ