চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহতভাবে বাড়ছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। গতকাল সোমবার বিশ্ববাজারে আবারও আড়াই শতাংশ বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দেশে বাড়ছে সকল প্রকার নিত্যপণ্যের দাম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি নির্ভর পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাড়ছে এসব পণ্যের দাম। জ্বালানি তেলের দাম না কমলে এসব পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম। সরকারি মহল বলছে, নিত্যপণ্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।
জানা গেছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে বিশ্ববাজারে এখন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলারে এসে ঠেকেছে। জ্বালানি তেলের এই দাম গত সাত বছরের মধ্যে বিশ্ববাজারে এখন সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর গত জুনে করোনার প্রকোপের মধ্যে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রতি ব্যারেলের দাম ৭৫ ডলারে ওঠে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের পাশাপাশি রেন্ট ক্রুড অয়েল ও হান্টিং অয়েলের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত এক মাসে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ। আর হান্টিং অয়েলের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশের ওপরে।
বর্তমানে ইউরোপের দেশগুলোতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট চলছে। সব মিলিয়ে বিশ্ববাজারে এখন সরবরাহ কম থাকার পরিস্থিতিতে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেকের সদস্যদেশগুলো সরবরাহ বাড়াতে চায়। তারা বেশ কিছুদিন ধরে সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দৈনিক তেল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম আবাসন প্রতিষ্ঠান এভারগ্র্যান্ড গ্রুপের দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে, এমন খবরে এশিয়ার পুঁজিবাজারের পাশাপাশি তেলের বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সম্প্রতি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক এবং অন্য বড় উৎপাদনকারীরা তেলের উৎপাদন না বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারও প্রভাব পড়ে তেলের বাজারে। বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ওয়ান্দার বিশ্লেষক ক্রেগ এরলাম বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘বাজারে এখনো অস্থিরতা রয়েছে। সামনের মাসগুলোতে জ্বালানিসংকট বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবে থাকবে। এর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি এবং কঠোর মুদ্রানীতির সম্ভাবনা বাজারে চাপ তৈরি করছে।’
আমদানি নির্ভর পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাড়ছে এসব পণ্যের দাম। জ্বালানি তেলের দাম না কমলে এসব পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা খুবই কম।
সম্প্রতি বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ দাম উঠেছে প্রাকৃতিক গ্যাসেরও। এতে দেশগুলো তেল আমদানিতে জোর দেওয়ায় এ পণ্যের দামও বাড়ছে। করোনা কেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা যায় গত বছরের নভেম্বর থেকেই। তবে চলতি বছরের জুন থেকে দাম বাড়ার প্রবণতায় নতুন হাওয়া লাগে।
প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি বা আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) গত জুলাইয়ের শুরুতে এক পূর্বাভাসে বলেছে, বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা আগামী বছরের শেষ দিকে আবার করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। সংস্থাটির (আইইএ) মতে, চলতি ২০২১ সালে বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা মোটামুটি বাড়বে। তবে আগামী বছর জ্বালানি তেলের দৈনিক চাহিদা বেড়ে ১০ কোটি ৬ লাখ ব্যারেলে উন্নীত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসও মাস তিনেক আগে তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা দেখা গিয়েছিল, তা দূর হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে।
এদিকে করোনা মহামারির ধাক্কায় কর্ম হারিয়ে, ব্যবসা গুটিয়ে অনেকে কষ্টে আছেন। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম দিন দিন লাগামহীনভাবে বাড়ছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আমদানি করা চাল বাজারে উঠতে শুরু করায় উচ্চমূল্যেই স্থির হয়ে আছে সকল প্রকার চালের দাম। বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। এ সময় বেড়েছে আটা-ময়দার দামও। চিনির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যবসায়ীদের পছন্দের দামেই বিক্রি হচ্ছে চিনি।
ব্যবসায়ীদের দাবি, এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ আন্তর্জাতিক বাজার। আমদানি নির্ভর এসব পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে এর প্রভাব এখানকার বাজারে বাড়বেই। এর ওপর যুক্ত হয়েছে পরিবহন খরচ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশে বিদেশে সর্বত্রই পরিবহন খরচ, বিশেষ করে জাহাজ ও ট্রাক ভাড়া বেড়েছে। যা পণ্যের মূল্যে প্রভাব ফেলেছে।
এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, পেঁয়াজ হারভেস্ট করেছে সেই এপ্রিল মাসে, এতদিন পর্যন্ত পেঁয়াজ থাকে না। পেঁয়াজ চাষিরা সব বিক্রি করে দেন। পেঁয়াজ পচনশীল ও মজুদ রাখার তেমন কোনও ব্যবস্থা না থাকায় মৌসুমের শেষের দিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। গ্রীষ্মকালীন ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ বাজারে আসার পরপরই আগামী ১৫ থেকে ২ দিন পর দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব তো কেউ আটকে রাখতে পারবে না। এর প্রভাব তো পড়বেই। তবে নিত্যপণ্যের দাম অবশ্যই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে।
এদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়ছে। চায়ের দোকানে এক কাপ চা পান করতে বাড়তি লাগছে এক থেকে দুই টাকা। রুটি-বিস্কুটের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ছাত্রাবাস, মেস, রিকশার গ্যারেজসহ বিভিন্ন জায়গায় খাবারের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। গত রোববারই রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব অবশ্যই দেশীয় বাজারে পড়বে, তা রোধ করা কঠিন। কাজেই নতুন বছরের অনেকগুলো নিত্যপণ্যের বাজার নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক বাজার দরের ওঠানামার ওপর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৯
আপনার মতামত জানানঃ