প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা মা-বাবা ও স্বামীর সম্পত্তির অংশ পান না এবং তারা যদি কিছু অংশ পানও, তা কোনোভাবেই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সমান নয়।
বর্তমান হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, কারো ছেলেসন্তান থাকলে মেয়েসন্তানরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায় না। তবে ছেলে না থাকলে ছেলে রয়েছে এমন মেয়েরা মৃত মা-বাবার সম্পত্তির অংশ পাবেন। যদিও নারীর অর্জিত সম্পত্তির অংশ তার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঠিকই পেয়ে থাকে।
সম্প্রতি হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট (১৯৩৭ সালের) বাংলাদেশে প্রযোজ্য বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, আইনে কোনো সুনির্দিষ্ট সম্পত্তির কথা নেই। ‘সম্পত্তি’ শব্দের অর্থ সব সম্পত্তি যেখানে স্থাবর বা অস্থাবর, বসতভিটা, কৃষিভূমি, নগদ টাকা বা অন্য কোনো ধরনের সম্পত্তি। কৃষিজমি ও বসতভিটার মধ্যে পার্থক্য করার সুযোগ নেই এবং এ ধরনের সম্পত্তি বিধবার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়।
খুলনার হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে করা এক আবেদনের (রিভিশন) শুনানি শেষে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। ওই আবেদন খারিজ (রুল ডিসচার্জ) করে হাইকোর্টের দেওয়া ২২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) মামলার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ নাফিউল ইসলাম রায় প্রকাশের বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর খুলনার হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে করা এক আবেদনের (রিভিশন) শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন।
আইনজীবী নাফিউল ইসলাম বলেন, খুলনার রাজবিহারী মণ্ডলের দুই ছেলে। তারা হলেন— জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডল ও অভিমন্যু মণ্ডল। অভিমন্যু মণ্ডল ১৯৫৮ সালে মারা যান। এ অবস্থায় মৃত ভাইয়ের স্ত্রী (গৌরী দাসী) কৃষিজমি পাবেন না, শুধু বসতভিটা থেকে অর্ধেক পাবেন— এমন দাবি নিয়ে ১৯৮৩ সালে নিম্ন আদালতে মামলা করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। মামলায় পক্ষ যথাযথভাবে না করায় ১৯৯৬ সালে তা খারিজ করে রায় দেন আদালত। তবে গৌরীর কৃষিজমির সম্পত্তি পাবেন না বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে খুলনার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আপিল করেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। আদালত ২০০৪ সালের ৭ মার্চ রায় দেন। রায়ে বসতভিটা ও কৃষিজমিতে গৌরী দাসীর অধিকার থাকবে বলা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন জ্যোতিন্দ্রনাথসহ অন্যরা। রিভিশন আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, রাজবিহারী মণ্ডলের আগে তার পুত্র অভিমন্যু মারা যান। গৌরী দাসী অভিমন্যুর বিধবা স্ত্রী। বিবাদী গৌরী শুধু বসতভিটার উত্তরাধিকারী এবং তাকে কৃষিজমি থেকে বঞ্চিত করার কারণ দেখা যাচ্ছে না। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া বসতভিটায় বাস করেছিলেন গৌরী এবং আপাতদৃষ্টিতে জীবনধারণের জন্য শ্বশুরের কৃষিজমির ওপর নির্ভরশীল তিনি। এই মামলার বিবাদী গৌরী দাসীর ক্ষেত্রে হিন্দু আইনের দায়ভাগা পদ্ধতি প্রযোজ্য। ১৯৩৭ সালের আইনের ৩(১) ধারা অনুসারে, বাবার আগে মারা যাওয়া ছেলের মতোই তিনি (গৌরী) তার শ্বশুরের রেখে যাওয়া সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন।
হাইকোর্টে এই মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে শুনানি করেন আইনজীবী উজ্জ্বল ভৌমিক। রিভিশন আবেদনের পক্ষে আইনজীবী এম এ জব্বার এবং গৌরী দাসীর পক্ষে আইনজীবী সৈয়দ নাফিউল ইসলাম শুনানিতে ছিলেন।
আইনজীবী উজ্জ্বল ভৌমিক বলেন, ১৯৩৭ সালের হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট অনুসারে স্বামীর কৃষি-অকৃষি উভয় জমিতে বিধবা নারীর অধিকারের কথা আছে। তবে এর আগে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, ছেলে, ছেলের ছেলে এবং ছেলের ছেলের ছেলে থাকলে বিধবারা সম্পত্তি পেতেন না। আইনটি করার কারণ হচ্ছে, ছেলে তথা তিন পুরুষের সঙ্গে বিধবাদের সম্পত্তির সমান ভাগ দেওয়া। তিনি আরও বলেন, কৃষি সম্পত্তি বিষয়ে ১৯৩৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের করা ওই আইনের বৈধতা নিয়ে তৎকালীন ফেডারেল কোর্টে প্রশ্ন ওঠে। আইনটি কৃষিজমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলে ১৯৪১ সালে ইন্ডিয়ান ফেডারেল কোর্ট অভিমত দেন। এই রায় এতদিন ধরে অনুসরণ করা হতো।
আইনজীবী সৈয়দ নাফিউল ইসলাম বলেন, ৮৪ বছর ধরে স্বামীর কৃষি জমিতে কোনো প্রাপ্য ছিল না হিন্দু বিধবাদের। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে এই অসঙ্গতি দূর করে রায় দিলেন হাইকোর্ট।
বাংলাদেশের সংবিধানের (১৯৭২) ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ ১৯৭৯-এ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষর করে, যেখানে নারীর অধিকার, ভোগ ও চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলা হয়েছে। অথচ সম্পত্তিতে সমান অধিকার না থাকার কারণে হিন্দু নারীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চনা, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে বাংলাদেশে হিন্দু নারী কিছুই পান না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে আইন করে হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এই আইন হওয়া উচিত, যাতে হিন্দু নারীরা আর বঞ্চিত না হন।
তারা বলেন, নারীর অধিকার মানে সব নারীর সমান অধিকার। রাষ্ট্র ও সংবিধান এই অধিকার নারীদের দিয়েছে। নারী জন্মানোর পর তাকে একটু একটু করে বোঝানো হয় তার অধিকার ভাইয়ের চেয়ে কম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও বাংলাদেশের সব নারী তার অধিকার কেন পাবে না। একটা জনমত তৈরি হয়েছে হিন্দু সম্পত্তি আইনের সুষ্ঠু বণ্টনের বিষয়ে। সম্পত্তিতে সমান অধিকার— এটা সময়ের দাবি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৮
আপনার মতামত জানানঃ