দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ হিসেবে তকমা দেয়া হয়৷ গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করা বড় কঠিন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে৷ দেশের অনেক মানুষ কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন না৷ তারাও সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই, রাষ্ট্রদ্রোহীর খেতাব পাচ্ছে। এই চর্চার পালে হাওয়া দিয়ে তথ্য মন্ত্রীর ‘জিব্বা টাইনা ছিঁইড়া ফালামু’ দেশের পরিস্থিতিকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বিডি সমাচারের তৃতীয় বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথীর বক্তব্যে এসব কথা বলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী। এ সময় বিদেশে থেকে সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ কড়া বার্তা দিয়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হোসেন। অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বেশি বলেও দাবি করেছেন প্রতিমন্ত্রী। পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা অনেক কথা বলি। অনেক নিউজ পোর্টাল; অনেক কিছু বাংলাদেশে। ফ্রিডম অব স্পিস। ওকে, স্যালুট, হোয়াই নট! বাট, যান তো দেখি ফ্রিডম অব স্পিস একটু কানাডায় দেখেন তো। ফ্রিডম অব স্পিস, একটু সিঙ্গাপুরে যান। একটু দেখেন না ফ্রিডম অব স্পিস কেমন হয়। যান একটু আমেরিকা থেকে ঘুরে আসেন না! সো, ডেফিনিটলি, উই হ্যাব দ্য ফ্রিডম।
বিদেশে বসে ইউটিউব ও ফেসবুকে অনেকেই সরকার বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হোসেন বলেন, চার-পাঁচটা রাজাকারের বাচ্চা, আমেরিকা-কানাড-লন্ডন, হ্যাঁ! সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত, পদবঞ্চিত, টাকা খাইয়া লম্বা লম্বা লেকচার! বাংলাদেশ-সরকার-নির্বাচন-প্রধানমন্ত্রী-বঙ্গবন্ধুকে নিয়া কথা বলো। জিব্বা টাইনা ছিঁইড়া ফালামু! থাকো তোমরা। কয়দিন তোমার ওই জিব্বা দিয়ে আমার সরকার, আমার বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, রক্ত দিয়ে কেনা বাংলাদেশ, এদের বিরুদ্ধে কথা বলবা! এই চার-পাঁচটা শিয়াল কুকুর তোমাদেরকে শায়েস্তা করতে বেশি সময় লাগবে না ইনশাআল্লাহ। আমরা প্রস্তুত, অনেক সহ্য করেছি। ইউটিউবে লেকচার দাও, না? ইউটিউবে! কত টাকা খাইছো মানুষ বোঝে। আমরাও ভাত খাই। আমরা ফিডার দিয়ে দুধ খাই না।
তিনি বলেন, সাংবাদিকতার নামে নষ্টামি-ভণ্ডামি করলে ‑ মেনে নেওয়া হবে না। আমরা সব আইন করে দিব ইনশাআল্লাহ। গণমাধ্যম আইন, সম্প্রচার আইন ‑ সব করেছি।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার জন্য এখন সব সম্ভব হচ্ছে। আমরা কোটি মানুষকে করোনার টিকা দিতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সব চাইতে বড় শক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি থাকলে কেউ না খেয়ে মরবে না, টিকা না নিয়ে কেউ করোনার সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করবে না।
অনুষ্ঠানে বিডি সমাচারের সম্পাদক মো. মহসিন হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিজান মালিক প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের আধিক্য। বর্তমানে সম্প্রচার সাংবাদিকদের জন্য বেতন কাঠামো প্রয়োজন। আর এই পেশা ফুল বিছানো নয়। অনেক ঝুঁকি আছে, চাপ আছে, সমস্যা আছে। এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবে এই পেশায় আসার আগে অনেক ভেবেচিন্তে আসতে হবে। আমাদের গণমাধ্যম অনেক বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমের মূল যে মূলধন, বিশ্বাস এবং আস্থা, তা কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? আমার প্রকাশিত সংবাদে পাঠকের বিশ্বাস কতটা! সেদিকটা আমাদের আরও ভাবতে এবং উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবাধিকার, জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে নাগরিকদের মুক্তচিন্তা ও বাক্স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীন সরকারের সব ধরনের তথ্য অনুসন্ধান, প্রাপ্তি এবং প্রদানের অধিকারসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে সরকার, জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করার স্বাধীনতা অর্ন্তভুক্ত।
ভয়াবহ করোনার দুর্যোগকালে নাগরিকদের কণ্ঠ রোধ করার অপচেষ্টা সরকারের মধ্যকার চরম অস্থিরতা, অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। সংবাদপত্র, সামাজিক গণমাধ্যমে মতামত দেওয়ার জন্য নাগরিকদের বা সংবাদকর্মীদের তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা, হুমকি দেওয়া জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ কোনো সরকারের নীতি হতে পারে না। দুর্যোগপূর্ণকালীন এ সময়ে যেকোনো তথ্য সংগ্রহ, সমালোচনা ও সরকারের ভুল ধরিয়ে দেওয়াটাই যে কোনো সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব। আর এ ধরনের সমালোচনা সহ্য করাও গণতান্ত্রিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
অথচ দেশে ঘটছে এর উল্টো। এমনকি দেশের বাইরেও কেউ নিরাপদ নয়। গণমাধ্যমের মুখ বেঁধে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘসময় বন্ধ রাখা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়; যা ছাত্র আন্দোলন দমানোর কার্যকর উপায় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সমালোচনাহীন সরকার মূলত শোষণের প্রতিচ্ছবি। মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করার এমন জয়জয়াকার আমরা আদতে স্বাধীন না পরাধীন এই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১১
আপনার মতামত জানানঃ