কেভিন রোস
ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম নিয়ে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত সিরিজ প্রতিবেদন ‘দ্য ফেসবুক ফাইল’ যেন ব্যাংকে যেতে যেতে আমেরিকান কোনো কমিক্স পড়ার মতই।
এই সিরিজ প্রতিবেদন এমন তথ্য সামনে এনেছে যেখান থেকে জানা যায়, ফেসবুকের দুই স্তরের এক বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে চলেছে; যার মধ্যে আছে— এটি জানত যে ইন্সটাগ্রাম কিশোরীদের মধ্যে নিজের শরীর নিয়ে হীনমন্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ফেসবুক যতটা প্রদর্শন করছে, টিকা নিয়ে এর ভুল তথ্য তার থেকে অনেক বেশি। এটা ভাবা খুব সহজ যে ফেসবুক চিন্তার বাইরে শক্তিশালী; তবে যথাযথ সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ফেসবুককে মাটিতে নামিয়ে আনা সম্ভব।
তবে এই সিরিজ প্রতিবেদনের আরেকটি অর্থ দাঁড় করানো যায়। যা মূলত আমাকে অনেক বেশি আলোড়িত করেছে। আর তা হলো: ফেসবুক বিপদে আছে।
অর্থনৈতিক বা আইনগত সমস্যা নয়। এমনকি মার্ক জাকারবার্গকে নিয়ে সিনেটরদের সমস্যাও নয়। আমি যে সমস্যাটা বলতে চাচ্ছি, তা হলো খুব সুস্থির পতন; যা কিনা সেই বুঝতে পারবে যে কোন কোম্পানিকে আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে দেখেছে। এটা হলো অস্তিত্বের সংকটের পুঞ্জিভূত মেঘ যা একটি কম্পানির মাথার উপর ঝুলে থাকে; যার সবথেকে ভালো দিনগুলো এখন অতীত, যে পরিচালনা এবং প্রোডাক্ট সংক্রান্ত সম্ভাব্য সবকিছুকেই অগ্রাধিকার দেয় এবং যে কারণে পুনরুত্থানের জন্য তার চেষ্টা তাকে আরো আশাহত করে তোলে। এগুলো বাইরে থেকে খুব একটা বোঝা যায় না। কিন্তু ভেতরে প্রতিদিন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র তৈরি হয়, জাহাজটা ডোবাতে— ব্যবহারকারীবান্ধব জনপ্রিয়তা হ্রাস, অতি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠা, কার্যনির্বাহীদের সমস্যা, মেধাবী কর্মচারী কমে আসা এমনই কিছু ছিদ্র।
ফেসবুকের সমালোচনাকারীদের এটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তারা কোম্পানির আকার এবং প্রভাব নিয়েই বাড়িয়েচাড়িয়ে বলে যাচ্ছে ক্রমাগত, তবে কোম্পানির ভুল পদক্ষেপ নিয়ে তাদের কথা নেই কোনও। গত বৃহস্পতিবার এক সিনেট অধিবেশনে আইনপ্রণেতার কোম্পানির আসক্তি সৃষ্টিকারী প্রোডাক্ট ডিজাইন এবং এর কয়েক বিলিয়ন ব্যাবহারকারীদের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্নে ফেসবুকের নিরাপত্তার গ্লোবাল হেড এন্টিগন ডেভিসকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ডেভিসকে করা বেশ কিছু প্রশ্নই ছিল আক্রমণাত্মক। তবে সবমিলে বড় বড় টেক অধিবেশনে যা হয়, পরিবেশেই বশ্যতার আমেজ থাকে, এখানেও তেমনই ছিল। আইনপ্রণেতারা যেন জিজ্ঞেস করছিল, এই গর্জিলা, দয়া করে তুমি টোকিওর উপরে জোরে জোরে হাঁটা বন্ধ করবে?
জার্নালটির সাথে স্পর্শকাতর এই ডকুমেন্টগুলো শেয়ার করেন ফেসবুকেরই সাবেক প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সিস হাউগেন। তিনি সামনে আনেন যে এই বিশাল কোম্পানিটি শক্তি ও প্রভাব হারাচ্ছে, অর্জন করছে না। ফেসবুকের নিজের গবেষণা অনুযায়ী এর প্রোডাক্টের একটা বড় অংশ যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। বরং নিজের টক্সিক ইমেজ পরিবর্তন করতে এবং ব্যবহারকারীদের এর এ্যাপ বাদ দিয়ে উপযুক্ত বিকল্প বেছে নেওয়া রোধ করতে, ফেসবুক চরম সীমা ছুঁয়ে ফেলছে বারবার।
গত সপ্তাহে জার্নালের সিরিজের একটি কিস্তিতে আপনি এই দুর্বলতা দেখতে পারেন। আর্টিকেলটি ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশ করেছে যে, কোম্পানিটি কীভাবে শিশুদের কাছে নিজেদের বাজারজাত করছে, এবং কৌশল হিসাবে এমনভাবে ভাণ করছে যেন এটি অত্যন্ত মূল্যবান ও দর্শকদের নিকট নতুন। আর্টিকেলটিতে ক্ষোভ বৃদ্ধির অনেক কারণ ছিল, যার মধ্যে একটি হলো— ফেসবুক গবেষকরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, এমন কোনো উপায় আছে যেখানে খেলার সময় বাচ্চারা শব্দ নিয়ে খেলতে পারে এবং তাদের বৃদ্ধি ঘটতে পারে।
যদিও শুনতে পাগলের মত শুনাবে। তবুও বলতে হচ্ছে— ১০ বছরের বাচ্চাদের খেলার সময়কে টার্গেট করে কীভাবে একটি সামাজিক মিডিয়া সমৃদ্ধ ও আত্মবিশ্বাসী হতে পারে! ফেসবুক যদি দুর্দম্যই হয় তাই বলে প্রচারের জন্য এইসব টুংটাং প্রকাশ করতেই হবে— বাচ্চারা, কী করছো তোমরা? অথবা মিম—লাইফ কোচ ফর অ্যাডাল্টিং!
এটা সত্য যে কমবয়সী ব্যবহারকারীদের জন্য ফেসবুকের আকাঙ্খা নতুন মার্কেট তৈরির জন্য নয়। আমেরিকান টিনএজারদের মধ্যে ফেসবুকের ব্যবহার দিনদিন কমে যাচ্ছে এবং ধারণা করা হচ্ছে এটা প্রায় তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। কোম্পানির আভ্যন্তরীণ গবেষণা পূর্বানুমান করছে যে ফেসবুকের প্রতিদিনকার ব্যবহার ২০২৩ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কমে যাবে। গবেষকরা আরও দেখিয়েছে যে ইন্সটাগ্রামের উন্নতি ফেসবুকের মূল এ্যাপের প্রতি ব্যবহারকারীদের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে কয়েক বছর ধরে। যার ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী টিকটকের কাছে মার্কেটের শেয়ার হারিয়েছে ফেসবুক এবং কমবয়েসীরা আগে যতটা কন্টেন্ট পোস্ট করতো, এখন তার ধারে কাছেও করছে না।
‘ফেসবুক বুড়োদের জন্য’— এটাই ছিল আভ্যন্তরীণ দলিল অনুসারে সবথেকে পাশবিক রায় ফেসবুকের জন্য; যা কোম্পানির গবেষকদের বলেছিল ১১ বছর বয়সী একটি ছেলে।
ফেসবুকের সমস্যা নিয়ে ভাবার ভালো উপায়, এরা দুটো ভিন্ন স্বাদে আসে: বেশি ব্যবহারকারী হওয়ার উদ্ভুত সমস্যা, এবং যে ধরনের ব্যবহারকারী ফেসবুকের প্রয়োজন তা অত্যন্ত কম থাকা— যেমন সংস্কৃতি তৈরি, প্রবণতার মানদণ্ড ঠিক করা, বিজ্ঞাপনদাতা-ঈপ্সিত কমবয়সী আমেরিকান।
দ্য ফেসবুক ফাইলে দুই ধরনের সমস্যার প্রমাণই আছে। প্রথমটা হলো, উদাহরণস্বরূপ, কোম্পানিটির উন্নয়নশীল বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে নেয়া শৃঙ্খলাহীন পদক্ষেপের দিকে তাকান। এই ধরনের সমস্যার সমাধান কিংবা উন্নতি সম্ভব। দ্বিতীয় সমস্যা হলো— কোম্পানির ফাউন্ডিং সদস্যারা যখন প্লাটফর্ম ছেড়ে যায় সার্বজনীনভাবে— এটা ওই কোম্পানিকে হত্যা করে। ফেসবুকের এক্সিকিউটিভরা এটা নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় আছে।
জার্নালটির সিরিজ প্রতিবেদনের তৃতীয় আর্টিকেলটা নেয়া যায়; যা কিনা ২০১৮ সালে রাগপূর্ণ এবং অপমানজনক আলাপ এড়িয়ে অর্থপূর্ণ সামাজিক মিথষ্ক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ফেসবুকের এর নিউজ ফিডের এলগোরিদম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের উপর করা।
এলগোরিদমের পরিবর্তনটা এমনভাবে দেখানো হয় যে এর উদ্দেশ্য অনেক মহৎ, যা মানুষের কথোপকথনকে সহনশীল করবে। কিন্তু আভ্যন্তরীণ গবেষণা দেখায় যে, এটি মূলত বছর ধরে ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ততা কমে যাওয়া রোধে করা হয়েছিল। প্লাটফর্মটির লাইক, শেয়ার, কমেন্ট কমে যাচ্ছিল। এক্সিকিউটিভরা নিউজ ফিড এলগোরিদম এমনভাবে সাজান যে এটি ওই ধরনের কন্টেন্টকে প্রমোট করে যা অনেক বেশি লাইক কমেন্ট এবং রিয়্যাকশন পায়; একভাবে বলা যায় যে কন্টেন্ট মানুষকে রাগান্বিত করে।
ফেসবুকের একজন মুখপাত্র জো অসবর্ন বলেন, লাভ বৃদ্ধির চেয়ে সমাজকে রক্ষা করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফেসবুকের নিরাপত্তার জন্য ৪০ হাজার কর্মী কাজ করে এবং ২০১৬ থেকে আমাদের এক্ষেত্রে বিনিয়োগ ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; তবু কথিত আছে আমরা এতো বিনিয়োগ অগ্রাহ্য করেই ফিডব্যাকে যথাযথ নজরদারি করি না।
ফেসবুকে ধ্বংস হয়ে গেছে এটা বলার সময় এখনও আসেনি। গত বছরে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞাপন থেকে আসা রাজস্ব এবং মহামারিতে কিছু প্রোডাক্টের ব্যবহারে অভাবনীয় বৃদ্ধি এর কারণ। আমেরিকার বাইরের দেশগুলোতেও ফেসবুক ফুলে ফেঁপে উঠছে এবং আভ্যন্তরীণ সমস্যা সত্ত্বেও সেখানে সফল হতে পারে কোম্পানিটি। কোম্পানিটি নতুন বেশ কিছু ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে; যেমন অগমেন্টেড ও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি প্রোডাক্টসের ক্ষেত্রে, এক্ষেত্রে তারা সফলে হলে স্রোতের দিক বদলে যাবে।
কিন্তু ফেসবুকের গবেষণা একটা পরিষ্কার গল্প বলছে যা কিনা আনন্দের নয়। এর কমবয়সী ব্যবহারকারীরা স্ন্যাপচ্যাট ও টিকটকে বেশি সময় কাটাচ্ছে এবং এর বয়স্ক ব্যবহারকারীরা টিকা বিরোধী মিম শেয়ার করছে এবং রাজনৈতিক তর্কে জড়াচ্ছে। ফেসবুকের কিছু প্রোডাক্ট সংকুচিত হয়ে এসেছে, তো কিছু প্রোডাক্ট ব্যবহারকারীদের রাগান্বিত করছে অথবা আত্ম-সচেতন করে তুলছে।
ইতিহাস আমাদের শেখায় যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলো খুব কমই শৃঙ্খলার সাথে বেড়ে ওঠে এবং টেক কোম্পানিগুলো তাদের পতনের সময় অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাইস্পেস এর কথা মনে পড়ছে আমার; যার বৃদ্ধি ছিল অভাবনীয় এবং শেষ হয়েছিল ব্যবহারকারীদের তথ্য বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রির মাধ্যমে। ফেসবুকের আগামী কিছু বছর গত কয়েকবছরের থেকে অনেক বেশি খারাপ হতে পারে।
এর কোন কিছুই এমনটা বলছে না যে ফেসবুক শক্তিশালী নয়, এটির নিয়ন্ত্রণ উচিত নয় অথবা এর নেয়া পদক্ষেপ সুবিবেচনার যোগ্য নয়। এটা একই সঙ্গে সত্য যে ফেসবুকের পতন ঘটছে এবং এটি এখনও ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী কোম্পানি; যা কিনা বৈশ্বিক রাজনীতি ও সংকৃতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
গর্জিলাও অবশেষে মারা যায় এবং যেটা ফাঁস হওয়া এই ফেসবুক ফাইল সামনে নিয়ে আসল, তা হলো ফেসবুকও একদিন নিশ্চিহ্ন হবে।
[কেভিন রোস একজন প্রযুক্তি বিষয়ক কলাম লেখক এবং ‘ফিউচারপ্রুফ: নাইন রুলস ফর হিউম্যানস ইন দ্য এজ অব অটোমেশন’এর লেখক। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ স্টেটওয়াচের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল।]
অনুবাদ: সরকার শুভ্র
আপনার মতামত জানানঃ