কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনায় কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালে ২৬টি যন্ত্রপাতি কেনায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এর পরই দুদক বাদী হয়ে মামলা করে।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন, হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাধায়ক ডাক্তার মো. আবু হাসানুজ্জামান, ঢাকা মহাখালীস্থ স্বাস্থ্য বিভাগের অ্যাসিসট্যান্ট রিপিয়ার কাম-ট্রেনিং ইঞ্জিনিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) এএইচ, এম আব্দুল কুদ্দুস ও যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স প্যারাগন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জাহেদুল ইসলাম।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ৯ খাতের মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনায় বাজার দরের থেকে কয়েকগুণ বেশি দর দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা দুদকের তদন্তে উঠে আসে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে দুর্নীতির আশ্রয়ে পরিকল্পিতভাবে সরকারের ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা আত্মসাত করেন। তাদের এই দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ভেন্টিলেটরসহ একটি অ্যানেসথেসিয়া যন্ত্র কেনা হয়েছে ৭১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। এ রকম দুটি যন্ত্র কিনতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে যে প্রতিষ্ঠান থেকে এই যন্ত্র দুটি কেনা হয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি যন্ত্রের বাজারদর ১৭ লাখ ১৮ হাজার ২১৫ টাকা। অর্থাৎ দুটি যন্ত্র কিনতে সর্বোচ্চ খরচ হতো ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩০ টাকা। কিন্তু ১ কোটি ৯ লাখ ২৩ হাজার ৫৭০ টাকা বাড়তি ব্যয় করা হয়েছে।
ট্রান্সকুটেনাস ইলেকট্রিক্যাল নার্ভ স্টিমুলেটর (টেন্স) নামে দুটি যন্ত্র কেনা হয় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু এই যন্ত্রের বাজারমূল্য প্রতিটি ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ইলেকট্রোকোটেরি ইউনিট নামে একটি যন্ত্র ৭ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়। কিন্তু এই যন্ত্রের বাজারমূল্য ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। দেশের বাজারে প্রতিটি আইআরআর মেশিনের দাম ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ তারা এই মেশিন ৬ লাখ টাকায় কেনা দেখিয়েছেন। এমন পাঁচটি যন্ত্র কেনা বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩০ লাখ টাকা।
জাপানের তৈরি ডেন্টাল ইউনিট নামে একটি যন্ত্র কেনা হয়েছে ৪৮ লাখ টাকায়। যার বাজারমূল্য মাত্র ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিটি ডায়াথারমি যন্ত্র ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা দেখিয়ে চারটি যন্ত্র ৪৪ লাখ ৪০ হাজার টাকায় কেনা হয়। কিন্তু বাজারে প্রতিটি যন্ত্রের দাম ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮২৫ টাকা। দুটি টেন্সটেম ইকো বেসিক মডেলের টেন্স কেনা হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু বাজারে প্রতিটির দাম ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
৭৫০০ মডেলের চারটি পালস অক্সিমিটার কেনা হয়েছে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে। বাজারে একটি যন্ত্র কিনতে খরচ পড়ে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪০ টাকা। কোরিয়ার তৈরি ইসিজি ১২ চ্যানেল ৫টি যন্ত্র কেনা হয়েছে ৩৯ লাখ টাকা দিয়ে। তবে বাজারে এই একটি যন্ত্র কেনা যায় ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। মাল্টিপ্যারামিটার পেশেন্ট মনিটর নামে পাঁচটি যন্ত্র কেনা হয়েছে ৬০ লাখ টাকায়। বাজারে একটি যন্ত্রের দাম ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা দিয়ে ১০ ধরনের ২৬টি যন্ত্র কেনা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ভ্যাট ও আয়কর বাদ দিয়ে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় আসামিরা সরকারের ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকার ক্ষতি করেছেন— এ মর্মে সত্যতা পায় দুদক।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির যেসব তথ্য সময়ে-সময়ে উদঘাটিত হচ্ছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত— এটি আজ প্রমাণিত। বলা চলে, তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বত্রই চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিযোগিতা।
স্বাস্থ্য খাতে সব ধরনের কেনাকাটা, নিয়োগ, পদায়ন, বদলিসহ এমন কোনো কাজ নাকি নেই, যেখানে দুর্নীতি হয় না। একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্য খাত ঘিরে অপ্রতিরোধ্য যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, সর্বত্র তাদের সরব পদচারণা লক্ষ করা যায়।
তারা বলেন, বস্তুত দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। সরকারি হাসপাতালে কেনাকাটাসহ স্বাস্থ্য খাতে লুটপাট ও দুর্নীতির যে রাজত্ব কায়েম হয়েছে; দ্রুত তার মূলোৎপাটন করা হবে, এটাই প্রত্যাশা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ