দেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় কোটিই প্রবীণ (৬০ ঊর্ধ্ব)। বিষণ্ণতা, মুখ ও দাঁতের খারাপ স্বাস্থ্য, বিশেষ খাদ্য পরিহারের অভ্যাস ও অসংক্রামক রোগের উপস্থিতির কারণে এদের এক চতুর্থাংশই অপুষ্টিতে ভুগছেন। আর অর্ধেকেরও বেশি প্রবীণ পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে আছেন। তবে পুরুষের তুলনায় নারীর অপুষ্টির হার বেশি। এছাড়া জীবনসঙ্গীহীন প্রবীণদের মাঝে অপুষ্টির হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ ও পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে আছেন ৬৫ দশমিক ৩ ভাগ।
বিশ্ব প্রবীণ দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এমন বাস্তবতায় শুক্রবার (১ অক্টোবর) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালন করা হবে বিশ্ব প্রবীণ দিবস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকসের এক দল গবেষক প্রবীণ দিবস সামনে রেখে তিনটি গবেষণা করেন। সারা বিশ্বেই অন্যদের তুলনায় প্রবীণদের অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বেশি। বর্তমানে দেশে প্রবীণদের সংখ্যা আনুমানিক ১.৫ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সালে সংখ্যাটি হবে ৩.৫ কোটি।
গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রবীণরা কী কী কারণে অপুষ্টিতে ভোগেন তা খুঁজে বের করা। এ লক্ষ্যে বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের উদ্যোগে ঢাকার উত্তরখান উপজেলার মুণ্ড, পোলারটেক ও ভাটুলিয়া গ্রামের ১২৫ জন প্রবীণের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এরপর সংগৃহীত তথ্য পর্যালচোনা করে গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে। এই গবেষণায় প্রবীণদের অপুষ্টির জন্য চিহ্নিত প্রধান কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে তাদের মধ্যে বিষণ্ন্নতা, মুখে ও দাঁতের খারাপ স্বাস্থ্য, বিশেষ খাদ্য পরিহারের অভ্যাস এবং অসংক্রামক রোগের উপস্থিতি রয়েছে।
বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। জরিপে জানানো হয় যে, করোনা মহামারির প্রভাবে প্রবীণদের অবস্থা আরো খারাপ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে প্রবীণদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাসংক্রান্ত তথ্যে এই বক্তব্যের প্রমাণ মেলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ৫৬ শতাংশের বয়সই ৬০ বছরের ওপরে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রবীণদের অপুষ্টির জন্য চিহ্নিত প্রধান কারণগুলো হচ্ছে— বিষণতা, মুখ ও দাঁতের খারাপ স্বাস্থ্য, বিশেষ খাদ্য পরিহারের অভ্যাস এবং অসংক্রামক রোগের উপস্থিতি। বিষণ্ণতায় ভোগা প্রায় ৪০ শতাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন। স্বাভাবিকের তুলনায় বিষণ্ণতায় ভোগা প্রবীণদের অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কা ১৫.৫ গুণ বেশি। যেসব প্রবীণের মুখ এবং দাঁতের খারাপ স্বাস্থ্য তাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন। মুখ ও দাঁতের সুস্বাস্থ্যে থাকা প্রবীণদের তুলনায় মুখ ও দাঁতের খারাপ স্বাস্থ্যযুক্ত প্রবীণদের অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কা ৭.৩ গুণ বেশি। মাংস দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এবং ডিম জাতীয় খাবার পরিহার করা প্রবীণদের মধ্যে অপুষ্টি এবং পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি— দুটোই বেশি। স্ট্রোক বা পক্ষঘাতগ্রস্ত প্রবীণদের মধ্যে অপুষ্টির হার বেশি।
অন্যদিকে আরেক গবেষক ডা. মঈনুল হাসান সম্পাদিত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রবীণদের বাতব্যথার ব্যাপকতা সম্পর্কে বলা হয়, প্রবীণদের জন্য বাতব্যথা একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবীণদের বেলায় এর ব্যাপকতা বিষয় তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। ৫২ শতাংশ প্রবীণ বাতব্যথায় ভুগছেন, যাদের অর্ধেকেরও বেশি মাঝারি মাত্রায় শারীরিকভাবে অক্ষম, পুরুষদের (৪৩.৪ শতাংশ) তুলনায় নারীদের (৫৬.৬ শতাংশ) মধ্যে সমস্যাটি বেশি পাওয়া গেছে। বাতব্যথায় ভোগা প্রবীণদের মধ্যে কোমর ব্যথা (৪৩.৪ শতাংশ) এবং হাঁটুতে ব্যথার (৩৭.৪ শতাংশ) সমস্যা বেশি দেখা গেছে। বাতব্যথায় ভোগা প্রবীণদের মধ্যে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং ফ্রোজেন শোল্ডারে ভোগার হার যথাক্রমে ৪ শতাংশ ও ৪.৫ শতাংশ।
সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিয়া হাসিনের নেতৃত্বে গবেষকদলের পরিচালিত ‘নিরাময় অযোগ্য রোগীদের জন্য হোম বেসড প্যালিয়েটিভ কেয়ার : বাংলাদেশে সম্ভাবনা’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, জীবন সীমিত ও নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবারের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আত্মিক সেবা দেওয়া একটি সার্বিক প্রচেষ্টা ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ বা প্রশমন সেবা। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ নিরাময় অযোগ্য বা দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন। ২০০৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ, হোমকেয়ার এবং কমিউনিটিভিত্তিক তিন ধরনের প্যালিয়েটিভ সেবা দিয়ে আসছে।
গবেষণা দলের প্রধান গবেষক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তৌহিদুর রহমান। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, যারা প্রবীণ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তারা অপুষ্টিতে বেশি ভোগেন। সেই সঙ্গে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তারাও অপুষ্টিতে ভুগছেন বেশি। কারণ এসব শ্রেণির মানুষের পুষ্টি বিষয়ে তেমন ধারণা নেই। এ ছাড়া অনেকে সচেতন থাকলেও টাকার অভাবে দেহে পুষ্টি বাড়াতে পারেন না।
তিনি বলেন, পুষ্টিহীনতায় ভোগা প্রবীণদের অধিকাংশই প্রান্তিক অঞ্চলের। এই জনগোষ্ঠীর পুষ্টিহীনতা দূর করতে সচেতনতামূলক কর্মশালা প্রয়োজন। প্রবীণ নারীদের অপুষ্টিতে ভোগার পরিমাণ অনেক বেশি। যে কারণে তাদের বিষয়ে এলাকা গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি রাখা উচিত। সেই সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয়ভাবে প্রবীণদের বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে।
তৌহিদুর বলেন, ‘এখানে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ওনারা আমাদের দেশে বড় একটি জনগোষ্ঠী। সমাজ গঠনে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ওনাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে না পারলে তাদের পুষ্টির সমস্যা সমাধান হবে না। পুষ্টিহীনতায় ভোগার কারণে তাদের দেহে অন্যান্য রোগগুলো বেশি দেখা মিলছে। এর মধ্যে কিডনি, হৃদরোগ বেশি দেখা মিলছে। তাদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিত করতে হবে।’
এই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি মানসিক বিপর্যয়ে ছিলেন প্রবীণরা। এমন পরিস্থিতিতে থাকার কারণে বলাই যায়, করোনা সংক্রমণের কারণে প্রবীণদের মানসিক সমস্যার এই হার আরও বেড়েছে।
আজ বিশ্ব প্রবীণ দিবস
১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে দিবসটি পালন করা শুরু হয়।
এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ডিজিটাল সমতা সকল বয়সের প্রাপ্যতা’। প্রবীণ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কল্যাণমূলক সংগঠনগুলোকেও প্রবীণদের কল্যাণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাবিশ্বেই অন্যান্যদের তুলনায় প্রবীণদের মধ্যে অপুষ্টি বা পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বেশি।
জানা যায়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে সংবিধানে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করেন।
সমাজকল্যাম মন্ত্রণালয় জানায়, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকার বয়স্কভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করে যার আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় ৪৯ লাখ প্রবীণ নাগরিক ভাতা পেয়েছেন। চলমান অর্থবছরে এর আওতা আরও বাড়ানো হয়েছে। সরকার ২০১৪ সালে প্রবীণ ব্যক্তিদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৫ প্রণয়ন করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে সকাল ১০টায় প্রবীণ ভবনের চতুর্থ তলায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া আইসিডিডিআরবির উদ্যোগে সন্ধ্যায় অনলাইন ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তর ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণনিবাসের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছরই প্রবীণ দিবসে নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কতটুকু প্রয়োগ করা হয়? প্রকৃতপক্ষে পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের বোঝা মনে করা হয়। তাদের সম্মান, মর্যাদা কিংবা কষ্টের কথা কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণদের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলো তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে পারলে পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশ অনেক বেশি উপকৃত হতে পারত।
তারা বলেন, প্রতি বছরই তো দিবসটির প্রতিপাদ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু ওই একটি দিনেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। প্রবীণরা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রে কতটুকু নিরাপদ বা সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, এ খবর ক’জন রাখেন? প্রবীণরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম না থাকায় এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে। তারা জীবনধারণের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন।
আরও বলেন, পুষ্টিকর খাবারের কথা না হয় বাদই দিলাম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মহামারি কোভিড-১৯। যারা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, তাদের একমাত্র অবলম্বন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা। এ মুনাফাও কেটে রাখা হচ্ছে। তাছাড়া এ মুনাফার টাকা উঠাতে গিয়ে কী পরিমাণ ঝক্কি-ঝামেলার শিকার হতে হচ্ছে, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন।
প্রবীণদের জীবনের মানোন্নয়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে আমাদের দেশেও বাস্তবায়ন করা হোক— আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে এটাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১২
আপনার মতামত জানানঃ