চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজশাহী মহানগর পুলিশের ২ কর্মকর্তাসহ ৬ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার আরএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস গণমাধ্যমকে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বরখাস্ত কর্মকর্তারা হলেন— সহকারী ট্রাফিক উপপরিদর্শক নাসির উদ্দিন ও সহাকারী উপপরিদর্শক সেলিম শাহজাদা। এ ছাড়া, শঙ্কর, শাহ আলম, সারওয়ার ও রিপন আলী নামে ৪ কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
সিরোইল পুলিশ বক্সের ভেতরে ডেকে নিয়ে ২ জনের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস বিস্তারিত তথ্য দেননি। তিনি বলেন, ‘চাকরি শৃঙ্খলা ভাঙায় তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।’ অভিযোগ পাওয়ার পরে আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক তাদের বরখাস্ত করার আদেশ দিয়েছেন। দ্রুততম সময়ে তাদের প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, গতকাল ৬ পুলিশ সদস্যের দল আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল। তারা ২ ব্যক্তিকে পুলিশ বক্সের ভেতরে নিয়ে গিয়ে তল্লাশি করে। কিছু না পেয়ে তাদের ব্যাগে মাদক রেখে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। দিনভর তাদের পুলিশ বক্সে আটকে রাখা হয়। ৬ পুলিশ সদস্য বিকাশের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে। পুলিশ বক্স থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে ভুক্তভোগী একজন ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত আত্মীয়কে বিষটি জানান।
সেইসঙ্গে তিনি আরএমপি কমিশনারের কাছেও অভিযোগ করেন। তবে অভিযোগকারীর পরিচয় জানা যায়নি। পুলিশ সূত্র আরও জানিয়েছে, কিছু পুলিশ সদস্য বছরের পর বছর সিরোইল, লক্ষ্মীপুর ও কাশিয়াডাঙ্গা পুলিশ বক্সে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তারা চাঁদাবাজিতে জড়িত।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা থেকে দু’জন নারী বৃহস্পতিবার সকালে বাসযোগে রাজশাহীতে তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসেন। তারা শিরোইল বাস স্ট্যান্ডে নামার পর পরই ফাঁড়ি পুলিশের এটিএসআই নাসির বাকিরা তাদেরকে আটক করে। এরপর ওই দুই নারীকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার দেখানোর হুমকি দেন ওই পুলিশ সদস্যরা। এ সময় তারা ভুক্তভোগীদের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। বাধ্য হয়ে ওই দুই নারী তাদের পরিবারকে বিষয়টি জানান। এরপর পরিবারের সদস্যরা বিকাশের মাধ্যমে এক লাখ টাকা দেন পুলিশকে। এছাড়াও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয় ওই দুই নারীর নিকট থেকে
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, প্রায়ই তারা মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও লাভ হয় না।
রাজশাহীতে বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই নিয়মিত ভাবেই বিভিন্ন অপরাধ সংগঠন করছে তারা।
চলতি বছরের শুরুতে মদ খেয়ে জুয়া খেলার অভিযোগে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) দুই জন এএসআই ও চার জন কনস্টেবলসহ মোট ছয় জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পুলিশের অপরাধপ্রবণতার প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘‘পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে এটা বলবো না৷ বলা উচিত এই প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে৷ আগে সেভাবে গণমাধ্যমে আসত না, এখন আসছে৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও আগে সেভাবে খেয়াল রাখত না, এখন রাখছে৷ ফলে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে৷”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, পুলিশের মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়নি৷ তাদের কিছু বিভাগ বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সেই বৃটিশ নিয়মেই তারা চলে৷ আর এই সংস্কারটা হচ্ছে না- এর কারণ পুলিশকে অনেক বেশি রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়৷ পুলিশের মধ্যে এমন কোন ক্যারিশমেটিক নেতা আসেনি যে তারা নিজের উদ্যোগেই সংস্কার করবে৷ আর আমাদের অর্থনীতি যেভাবে বেড়েছে তাতে পুলিশের মধ্যে এই দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে৷ অনেকেই অল্প দিনে ধনী হতে চান ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন৷”
প্রায় সোয়া দুই লাখ সদস্য নিয়ে পুলিশবাহিনী গঠিত। বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে ২৫ হাজারের মতো অভিযোগ জমা পড়ে সদর দফতরে। আর গড়ে দুই হাজার পুলিশের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতিসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেল ও আইজিপির বিশেষ সেলে সরাসরি অভিযোগ করা যায়। আর আদালতে বা থানায় ভুক্তভোগী সরাসরি মামলাও করতে পারেন। তাতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাস্তবে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা কি অত সহজ!
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ অন্যায় অনৈতিক কাজের কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এর সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধীরা বা অপরাধী গোষ্ঠী। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বা তাদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যেই সব বেআইনি অপরাধ করে যাচ্ছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পুলিশ সদর দফতরে আসে তার মধ্যে রয়েছে- হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, যৌন হয়রানি, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারের মতো অপরাধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অনেকেই নানাভাবে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে, আবার অনেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ করছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পোস্টিং ও পদোন্নতির কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্যের নানা অপকর্ম, অনিয়ম ও অপরাধের কারণে সরকারি এ সংস্থাটি এখন নানা প্রশ্নের মুখে। বিভিন্ন অনৈতিক ও অপরাধমূলক ঘটনায় পুলিশের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কেন জন্ম নিচ্ছে সেটি একটি প্রশ্ন। সময় এসেছে তাদের প্রশিক্ষণে কোনো ঘাটতি আছে কি না, খতিয়ে দেখার। এ ধরনের ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি করে। এটি খুবই বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪২২
আপনার মতামত জানানঃ