সরকার শুভ্র
তখন মায়েদের শুক্রবারগুলো ছিল শাবানার। আঙুলে আঁচল জড়ানো, নিচু চোখে তাকানো, লজ্জা পেয়ে পর্দার আড়াল নে’য়া আর বিপদে রাজ্জাক অথবা আলমগীরের পেছনে লুকিয়ে পড়া। ‘জেন্ডার ইনইকুইলিটি’ তখন থেকেই বাঙলা সিনেমার ‘নাড়ী ছেঁড়া ধন’। সিনেমায় অন্তত দু’জন নারী যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তখন তাদের আলাপের বিষয় একটা সময় পুরুষে গিয়ে দাঁড়ায়। কিংবা নারীর কথা— কোনও নারী নয়, বলে একজন পুরুষ। এগুলো হাবাগোবা চুলে তেল দে’য়া ছেলেদের বলা কথার মতো শোনালেও, সমাজ এবং শিল্পের জার্নিতে নারীদের থার্ড ক্লাসের প্যাসেঞ্জার হয়ে ভ্রমণ করার টিকিট এগুলোই।
‘সিনেমা সমাজ পরিবর্তন করতে পারে না। কখনও করেওনি’— সত্যজিত রায়ের এই কথার সামনে গণেশ উল্টে দিয়েছে বাঙলা চলচ্চিত্র (১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমাস্ট ম্যাগাজিনে দে’য়া সাক্ষাৎকার)। আদতে চলচ্চিত্র বা কোন শিল্পই কেবল বিনোদনের খোরাক হতে পারে না। শিল্পের সোশ্যাল ভ্যালু সবসময়ই ছিল। অন্যান্য শিল্পের চেয়ে সিনেমা মানুষের সাথে সহজে কানেক্ট করতে পারে। কোনও সিনেমা শেষ ক’রে বাড়ি ফেরার আগেই আমাদের মনস্তত্ত্ব অব্দি পৌঁছে যায় চরিত্রগুলো। নায়কের হেয়ারস্টাইল বা নায়িকার ব্লাউজের কাটিং। জোর ক’রে চুমু খেলে প্রেম হয়ে যাওয়া কিংবা উত্যক্ত করা, এমনকি অপহরণ এবং ধর্ষণের মতো অপরাধও সমাজের চোখে সয়ে গেছে সিনেমার কল্যাণে।
‘টেকনোলজিস অব জেন্ডার’ প্রবন্ধে তেরেসা ডি লরেটিস বলেন, ‘জেন্ডার হলো চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রযুক্তির ফসল।’ একটা সময়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় নারীদের জন্য ছিল অপমানজনক পেশা। ‘কথিত ভদ্রঘরের’ নারীরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কথা চিন্তাও করতেন না। ‘দ্য লাস্ট কিস’ বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। ‘জেন্ডার ইনইকুইলিটি’ এখানেও ছিল সদ্য পালিশ করা জুতোর মতো চকচকে। ১৯৩১ সালের এই চলচ্চিত্রে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন ঢাকা নবাব পরিবারের সদস্য খাজা আজমল। তবে অভিনেত্রীদের আনা হয়েছিল পতিতালয় থেকে। যারা মূলত নবাবদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশন করতেন। মূল নারী চরিত্রে অভিনয় করেন ললিতা। তিনি ছিলেন বাদামতলী পতিতালয়ের একজন যৌনকর্মী। চারুবালা, দেববালা (দেবী) নামের আরও দুই যৌনকর্মী অভিনয় করেন এই চলচ্চিত্রে। যদিও অভিনয় তাদের সামাজিক অবস্থানের কোনও পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি; আজও পারে না। তাদের আবার ফিরে যেতে হয়েছিল পুরনো পেশাতেই।
বাংলাদেশি সিনেমার সুদীর্ঘ ৯০ বছরের ইতিহাসে, সেই শুরু থেকেই নারী চরিত্র ছিল পরজীবী ঘরানার। পুরুষ চরিত্রের হাতে চাবুক তুলে দিয়ে পিঠ পেতে দে’য়ার করার কৌশল মাত্র। সমাজের প্রচলিত চিন্তার ছকে ফেলে সিনেমায় নারীর ভূমিকা, নারীকে উপস্থাপন করা হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে। নারীশক্তির বহিঃপ্রকাশ সেখানে কল্পনাতীত। মূলত সিনে ইন্ড্রাস্ট্রিগুলো চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চা করেছে বংশপরম্পরায়। নারীর কোমলতা একটা দীর্ঘ সময় অব্দি ছিল সিনেমার মূল পুঁজি। শুধু নারীর শরীর কিংবা সৌন্দর্যের বাণিজ্যিকীকরণ নয়, তাদের জীবনবোধকে চার দে’য়ালে বেঁধে ফেলার— সমাজের ক্রুর এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল চলচ্চিত্র।
সমাজের পছন্দসই সতীত্বের ধারণা, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত, সমাজে মানিয়ে চলার শিক্ষা, উঁচু স্বরে কথা না বলা, পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা, সন্তান জন্ম দে’য়া, সংসারের ভালো মন্দ নিয়েই পাখির খাঁচার সমান পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে জীবন কাটানোর কনসেপ্ট প্রমোট করেছে বাঙলা সিনেমা। যেখানে নারীরা আনন্দের সহিত পরনির্ভরশীল ছিল। রান্নাঘরের মশলার কৌটা সাজিয়ে রাখা কিংবা আঁচলে সংসারের চাবির গোছা বাঁধতে পারা অথবা ভাত খেতে থাকা স্বামীকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করাই তাদের জীবন। এই কনসেপ্ট সফলভাবে প্রমোট করেছে বাঙলা সিনেমা। এখনও দেশের নারীদের বড় একটা অংশের জীবন বাঙলা সিনেমের সমান দৈর্ঘ্যেই শেষ হয়ে যায়।
নারীরা শারীরিকভাবে দুর্বল— সমাজের এই প্রচলিত ধারণাকে বদ্ধমূল করার মাধ্যমও বাঙলা সিনেমা। নারীকে ফুলের পবিত্রতার সাথে তুলনা করার মতো জঘন্য চর্চা কিংবা ধর্ষণের দৃশ্যের পরে চিরায়ত ‘আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে’ ডায়ালগ বা আত্মহত্যার চেষ্টা মূলত নারীকে আরও দুর্বল করে তুলেছে সামাজিকভাবে, এমনকি তাদের নিজের কাছেও। এমনকি ধর্ষণকে মুনাফার কৌশলও বানানো হয়েছে চলচ্চিত্রে। একটা বড় সময় ধরে প্রায় প্রতিটা সিনেমাতেই ধর্ষণের দৃশ্য ছিল অবধারিত; যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পুরুষতান্ত্রিক। আজও ধর্ষিত নারী সমাজে মুখ দেখাতে লজ্জা পায়, ধর্ষক স্লোগান দেয় ধর্ষণের বিরুদ্ধে।
করোনাকালে বন্ধ সব সিনেমা হল, ভাঙা হচ্ছে এফডিসি। টেলিভিশনও ভাঁড়েদের দখলে। ইদানিংকালে তাই মানুষ ঝুঁকছে ওয়েব সিরিজে। হোম ডেলিভারির এই যুগে এ যেন হাতে স্বর্গ পাওয়া। নব্বই দশকের মাঝামাঝি ‘দি স্পট’ এর মাধ্যমে ওয়েব সিরিজ এর ধারণা সবার সামনে হাজির করেন নিউইয়র্কের নির্মাতা স্কট জাকারিন। সে হিসেবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে হাফপ্যান্ট পরা শুরু করেনি এখনও। তবে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে শ্লীল আর অশ্লীল নিয়ে বিতর্ক। এখানে এই বিতর্ক এড়িয়ে যাবো। তবে এটা ঠিক যে এখানেও আলোচনায় থাকার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নারী চরিত্র।
ওয়েব সিরিজের অধিকাংশ গল্পই গড়ে উঠছে নারীর সামাজিক অবস্থান, নির্যাতন আর নিপীড়নের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। নারী শক্তির উন্মেষ যেন সযত্নেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নারীরা প্রতিবাদী হয়েছে। তবে সমাজ এখনও আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। এখানেও সমস্ত দায় থেকে সমাজ মুক্ত। নারীকেই যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে। কর্মস্থলে, রাস্তায়, বাসে— ভীড়ের মধ্যে সাবধান থাকতে হবে নারীকেই। একজন পুরুষ কেন সাবধান থাকবে না— এই প্রশ্নের দেখা কোথাও পাইনি। যেন পুরুষ সুযোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক, আর নারী ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবে এটাই নিয়ম।
এই যেমন ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ সিরিজের মূল চরিত্র সাবিলা প্রকাশ্যে বলেন ‘আমিও’ এই সমাজে হেনস্থা ও হয়রানির শিকার। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমায় সমস্ত প্রতিকূলতা ঠেলে একজন নারীকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। ‘মহানগর’ বা ‘মরীচিকা’— প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল বা পার্শ্ব চরিত্রে থাকা নারীদের সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টাটা আজকের রাবণের চিতা। কখনও থামবে না। কিন্তু শুধু নারীর পরিবর্তনে সমাজ বদলাবে না, পরিবর্তন প্রয়োজন পুরুষেরও। নারীর অবদান অস্বীকারের এক চিরায়ত প্রবণতা বয়ে বেড়াচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। যেন নিজেদের অস্ত্বিত্বের লড়াই। সিনেমার নাম ধাম বদলে নতুন সংস্করণ এই ওবেজ সিরিজেও তাই জেন্ডার রিপ্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে নারীকে নিপীড়িত, ভোগ্যপণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করে হচ্ছে। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, আমাদের দর্শকদের বড় একটা অংশের রুচি সে অব্দি পৌঁছায়নি।
সিনেমার ইতিহাসে নারী নির্মাতাদের অবদানও স্বীকৃতি পাইনি সেভাবে। অনেকটা তুমুল বর্ষায় ঝাপ ফেলে দে’য়া দোকানের মতো অদেখাই থেকে গেছেন তারা। নারী থেকে গেছে অভিনেত্রীর বাণিজ্যিক নামের আড়ালে, নির্মাতা হয়ে উঠতে পারেনি সমাজের চোখে। কারণ এই অবস্থানটা পুরুষের। বাঙলা সিনেমায় এই চর্চা গানের ওই গাজার নৌকা, যা পাহাড়তলী অব্দি পৌঁছে যায়। যদিও তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, যখন ১৯৭০ সালে রেবেকা নির্মাণ করেছিলেন ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’। এরপরে ১৯৮৬ সালে অভিনেত্রী রোজি আফসারি নির্মাণ করেন ‘আশা নিরাশা’। ওই সময় থেকে এখন অব্দি অসংখ্য নারী নির্মাতা পেয়েছে আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। সফলতাও পেয়েছেন; তবু নির্মাতা বলতেই আমাদের চোখে হ্যাট পরা আধবয়সী অল্প ভুঁড়িঅলা কারও চেহারা ভেসে ওঠে। আমাদের অজান্তেই আমরা এড়িয়ে যাই নারী নির্মাতাদের।
১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকের হলিউডে নারীর অবস্থান ছিল হয় পতিতা নাহয় কুমারী। তবে জল গড়িয়েছে অনেকদূর। ষাট এং সত্তরের দশকে ফেমিনিস্ট ‘ফিল্ম থিয়োরি’ সিনেমা পাড়ার চেহারাই বদলে দেয়। গোটা বিশ্ব জুড়ে লিঙ্গ অবলুপ্তির সংগ্রাম চলছে তখন থেকেই। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে থাকছে না সেরা অভিনেতা সেরা অভিনেত্রীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরি। শুধু সেরা অভিনেতার জন্য একটি ক্যাটাগরি থাকবে। নারী ও পুরুষ দুজনেই এই এক ক্যাটাগরিতে পড়বেন। অথচ ‘জেন্ডার ইনইকুইলিটি’ বাঙলা সিনেমা থেকে ওয়েব সিরিজে চিত্রনায়িকা শাবানার সিম্বোলিক সেলাই মেশিনের চাকার সাথে আজন্মকাল ধরে ঘুরছে। নারীরা এখানে আজও পা-হীন মানুষের জুতোর মতো গৌরবের।
আপনার মতামত জানানঃ