প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়ানোর মামলার রায়ে আকতার হোসেন (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
আজ সোমবার (২০ সেপ্টেস্বর) সকালে তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬ সালের ৫৭ ধারায় আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জিয়াউর রহমান এই দণ্ডাদেশ দেন। রায় ঘোষণার সময় আসামি কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন।
রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ইসমতারা বলেন, ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাতে আসামি আকতার হোসেন তার নিজ ফেসবুক ওয়ালে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কে নিয়ে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করেন।
বিষয়টি সাক্ষী আল আমিনের চোখে পড়ে। পরবর্তীতে নাটোরের সিংড়া এলাকার মোখলেছুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেন। দীর্ঘ ৬ বছরে ৫ জন সাক্ষীর জেরা ও জবানবন্দি আদালতে আসে। সেটি সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে বিচারক আসামি আকতার হোসেনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এসময় আরও এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।
তিনি আরও জানান, পরবর্তী সময়ে রাজশাহীর নবগঠিত বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি বিচারের জন্য নথিভুক্ত হয়। মামলায় পাঁচ জনের সাক্ষ্য শেষে আকতার হোসেনকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন বিচারক মো. জিয়াউর রহমান।
এর আগে নেত্রকোনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি বিকৃত করে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে রাসেল মিয়া (৩৩) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি ওই উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের হানিফ মিয়ার ছেলে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি একসঙ্গে এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি আলাদাভাবে বিকৃত করেন। পরে সেই ছবিগুলো ফেসবুকে ও বিভিন্ন মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। বিষয়টি পুলিশের নজরে আসলে তাকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এ আইনে মামলার সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৭৩৪টি মামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় করা আরও ৩৩০টি মামলা বিচারের জন্য এ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে বেশির ভাগই হয়েছে আইনটির ২৫ ও ২৯ ধারায়। মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন এবং মানহানির অভিযোগে এ দুটি ধারায় মামলাগুলো হয়েছে। এ আইন হওয়ার আগে একই রকম অভিযোগে মামলা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায়।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত বছর সারা দেশে ৭৩২টি মামলায় ১ হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের প্রথম দুই (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) মাসে ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর এ আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অন্তত ৫০টি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৭ জন সাংবাদিককে।
আইনটি পাস হওয়ার আগে ও পরে এর কিছু ধারার অপপ্রয়োগ হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আইনটির ৯টি ধারা বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এসব ধারা সংশোধনের দাবি করে আসছে সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বিএনপি আমলে ২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মানহানি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়াসংক্রান্ত ধারাগুলো একই উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। আইনটি সরকার বা সরকারদলীয় ব্যক্তিদের সমালোচকদের বিরুদ্ধে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কেবল ট্রাইব্যুনালে নালিশি মামলা হয়েছে ৪৬৮টি। আর চলতি বছরের গত আট মাসে মামলা হয়েছে ২২০টি। অবশ্য এ ২০ মাসে উপাদান না থাকায় ৩২৯টি মামলা সরাসরি খারিজ করে দেন আদালত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের অন্যায়ের সমালোচনাকারীদের আর ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা বা এর আতঙ্কে রাখা। এবং এভাবে দেশকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া। এই আইনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন ফোরামে অধিকারসচেতন মানুষকে অবিলম্বে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/০২
আপনার মতামত জানানঃ