করোনাকালীন নবজাতকদের স্বাস্থ্যে দেখা দিয়েছে বড়সড় পরিবর্তন। প্রকট হয়ে উঠছে শিশুদের পুষ্টিহীনতাজনিত নানা সমস্যা। বিশেষ করে শিশুদের ওজনস্বল্পতার সমস্যা এ সময় আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রাথমিক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মহামারীর মধ্যে দেশে স্বল্প ওজনের শিশুর (০-৫ বছর বয়স পর্যন্ত) সংখ্যা বেড়েছে ৬ শতাংশেরও বেশি।
অপুষ্ট ও স্বল্প ওজনের শিশু বেড়েছে
বিবিএসের মাল্টিপল ক্লাস্টার ইন্ডিকেটর সার্ভে-২০২০ (এমসিআইএস) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইভ ডাটার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালেও দেশের পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের ৩৩ শতাংশের ওজন ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম।
সেখান থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তা নেমে আসে ২২ দশমিক ৬ শতাংশে। অন্যদিকে গত বছর কোভিডকালে স্বল্প ওজনের শিশুর হার ৬ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে।
কোভিডের আগেও দেশের পুষ্টিনিরাপত্তার সূচকগুলো খুব একটা সন্তোষজনক পরিস্থিতিতে ছিল না। ওই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ‘ফিল দ্য নিউট্রিশন গ্যাপ’ প্রতিবেদনের সর্বশেষ কিস্তির তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১৩ শতাংশ পরিবারের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার কেনার সামর্থ্য নেই।
সে হিসেবে প্রতি আট পরিবারের একটি পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারছিল না। সুষম খাদ্য গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে না পারায় ভাতের ওপরই তাদের নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি।
মহামারীর প্রাদুর্ভাব এ পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারী নারী-শিশুসহ পুরো জাতিকে এক ধরনের পুষ্টিঝুঁকির সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।
এর পেছনে কারণ
দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব স্পষ্ট। কাজের সুযোগ ও আয় কমায় ক্রয়ক্ষমতা কমেছে অনেক পরিবারের। ক্রয়ক্ষমতা কমায় এসব পরিবারকে পুষ্টির বদলে খাদ্যনিরাপত্তার দিকেই মনোযোগী হতে হয়েছে বেশি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পরিবারের শিশুদের স্বাস্থ্যে।
এছাড়া মহামারীকালে শিশুর অপুষ্টি ও ওজনস্বল্পতা বাড়ার পেছনে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধির বিষয়টিকেও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, করোনাকালে গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। বাল্যবিবাহের শিকার এসব নারীর গর্ভের শিশুও জন্ম নিচ্ছে অপুষ্টি ও ওজনহীনতাকে সঙ্গে করে। সামনের দিনগুলোয় বিষয়টি আরো জটিল রূপ নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে মহামারীর নেতিবাচক সম্পর্কে সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে মহামারীর মধ্যে মানুষের আয় কমেছে। পাশাপাশি নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে। ফলে এসব পরিবারকে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
একদিকে পরিবারের আয় হ্রাস, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর পড়েছে। আবার পুষ্টি পরিস্থিতিতে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, এমন কার্যক্রমগুলোয় সরকারের বরাদ্দ খুব বেশি বাড়ানো হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সাম্প্রতিক সময়ে মাথাপিছু আয় বাড়লেও পুষ্টি উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশ এখনো বেশ পিছিয়ে রয়েছে। আয় কমে যাওয়া ও দরিদ্রতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণে আয়ের কম অংশ ব্যয় করা, খাবার হিসেবে প্রধানত চালের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই অপুষ্টি পরিস্থিতির পরিবর্তন দ্রুত হচ্ছে না। এছাড়া খাদ্যাভ্যাসও এখানে অনেকটা দায়ী।
এ অবস্থায় কোভিড-১৯-এর অভিঘাত থেকে পুনরুদ্ধারসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুষ্টি নিশ্চিতে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, শিশুর অপুষ্টি ও ওজনস্বল্পতার সমস্যার ওপর কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তবে সেটি সাময়িক কোনো তথ্য দিয়ে নয়, পরিপূর্ণ সার্ভের মাধ্যমে তুলে আনতে হবে। এটা সত্য, কোভিডের আগে যে অর্জন হয়েছিল সেটি ধরে রাখা নিয়ে এখন সংশয় তৈরি হয়েছে।
কোভিডের আগে শিশুদের ওজনস্বল্পতার সমস্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তা সন্তোষজনক অবস্থায় ছিল না। আবার আঞ্চলিক পুষ্টি পরিস্থিতিও বেশ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অনেক কার্যক্রম এক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারে।
কিন্তু যাকে দেয়া প্রয়োজন তাকে না দেয়ার (মিস টার্গেটিং) কারণে লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না। তাই স্বল্প ওজনের শিশুর হার কমাতে অপুষ্টিজনিত ঝুঁকিতে থাকা মা ও শিশুর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। অপুষ্টিরোধে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি এগুলোর চাহিদা বৃদ্ধিতে আরো বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশুস্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, কম ওজনের শিশুদের নিয়ে ভিন্ন কোনো কর্মসূচি না থাকলেও মায়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এবং সঠিক পুষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সারা দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। মায়ের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারলে শিশুর সুস্বাস্থ্যও নিশ্চিত করা যাবে।
শিশুর পুষ্টিহীনতার বিষয়টি নিয়েও আমাদের বহুমাত্রিক কার্যক্রম রয়েছে। চরাঞ্চলের শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আমরা দেশের শতাধিক উপজেলায় এরই মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। সচেতনতা বাড়ানো ও মানুষকে পুষ্টিকর খাবারের বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫২
আপনার মতামত জানানঃ