আশফাক স্বপন
১০ সেপ্টেম্বর ছিল ভাষা সৈনিক বদরুল আলমের ৪১তম মৃত্যূবার্ষিকী। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি প্রথম শহীদ মিনারের নক্সা করেন। সেটা দেখে সারারাত জেগে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সেই শহীদ মিনার তৈরি করে। পরদিন সকাল থেকে মানুষের ঢল নামে সেই শহীদ মিনারে। দু’দিন পর পুলিশ এসে সেই শহীদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
বদরুল আলম আমার বাবা। আট বছর আগে তাঁকে নিয়ে এই লেখাটি লিখি। তারপর অবশ্য অনেক ঘটনা ঘটেছে। বদরুল আলমের স্ত্রী (আমার মা) আফজালুন নেসার অক্লান্ত চেষ্টায় ২০১৪ সালে বদরুল আলম ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। কয়েক বছর আগে আফজালুন নেসা আমাদের ছেড়ে চলে যান।
বদরুল আলমের মৃত্যুদিবসে লেখাটা পুনর্নিবেদন করছি।
বদরুল আলম ও প্রথম শহীদ মিনার
প্রাককথা
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলাদেশে কম বেশি সবার হৃদয় ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে আর্দ্র হয়ে ওঠে। আমার জন্য এই পবিত্র মাস যতটা না বেদনার আর দুঃখের, তার চাইতে বেশি গর্বের ও আনন্দের। এই মাস আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানাবার মাস, ভালবাসা জানানোর মাস – নানান বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক আয়োজনে বাংলাদেশে সর্বত্র মানুষ তাই করে, সেটা দেখে মন প্রসন্ন হয়ে ওঠে।
ফেব্রুয়ারির এই আবহে আমাদের বাড়িতে প্রতি বছর আরেকটা তীব্র ক্ষোভ ও বেদনার সুর যুক্ত হয়। ফেব্রুয়ারি আসার মাস দুয়েক আগে থেকেই আমার মা আফজালুন নেসা রাগে দুঃখে অভিমানে কাতর হয়ে পড়েন। তার ক্ষোভের কারণ – তার প্রয়াত স্বামী ও আমার বাবা ডাঃ বদরুল আলম, যিনি প্রথম শহীদ মিনারের রূপকার – তাঁর যথাযোগ্য মূল্যায়ন হয় নাই, তাঁর নামই অনেক আলোচনায় উচ্চারিত হয় না, এমনকি তার নাম হারিয়ে যেতে বসেছে।
এই নিয়ে আমারও যে ক্ষোভ নেই, তা নয় – তবে মায়ের মতো এই নিয়ে পত্র-পত্রিকা বা বেতার টেলিভিশনে ধর্ণা দিতে আমার অনীহা রয়েছে। মায়ের তাগাদার ফলে আমি এই নিয়ে ভাল করে ঐতিহাসিক তথ্যের খোঁজখবর নিয়ে লেখালেখি করার কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই কথা রাখা হয় নাই।
এর কারণ শুধু আলস্য নয়। নিজের বাবার জন্য জোর গলায় কোন দাবি করতে আমার কুণ্ঠা হয়—যদিও আমি মনে করি তিনি প্রথম শহীদ মিনারের রূপকার হিসেবে স্মরণযোগ্য। ইতিহাসে তাঁর যথাযোগ্য স্থান নিরূপণের দায়িত্ব আমার জন্য অস্বস্তিকর—দেশের বিদ্বৎজন, ইতিহাসবিদ, এরাই এই কাজটি করবেন, সেটাই অভিপ্রেত।
কিন্তু মাকে কে বোঝাবে সেই কথা? তাঁর কথা রাখতে গিয়েই আমার এই সংক্ষিপ্ত নিবেদন। বলা বাহুল্য ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মিনারের ঘটনা আমার জন্মের আগে ঘটেছে, সুতরাং আমার বক্তব্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়। বদরুল আলম সম্বন্ধে সব আহরিত তথ্য মা-বাবার কাছে অথবা তার ঘনিষ্টজনের কাছে শোনা।
সংস্কৃতিমনস্ক/সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ
প্রথম শহীদ মিনার প্রসঙ্গে আসার আগে বদরুল আলম সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা দিতে চাই। খুব ছোট বয়সে আমার বাবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয় – মা আর বাবা বিলেতে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য রয়ে যান, আমি ঢাকায় আমার বড় খালার বাসায় চলে আসি। সেটা ১৯৬৫ সালের কথা, আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। ১৯৬৯ সালে বাবা-মা ফিরে আসেন, তখন আমার বাবা-মায়ের সাথে পুনর্মিলন ঘটে।
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি – চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইরেও বদরুল আলমের শিল্প সংস্কৃতি, বিশেষ করে শিল্পকলার দিকে ঝোঁক ছিল। বিলেত থেকে ফেরার সময় সাথে বেশ কিছু ভারতীয় দীর্ঘবাদন রেকর্ড নিয়ে এসেছিলেন যা তখন পূর্ব পাকিস্তা্নে পাওয়া যেত না। সেই সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের গান ছিল, ছিল নির্মলেন্দু চৌধুরী, শচীন দেববর্মনের বাংলা গানও ।আর ছিল সেকালের স্পুল টেপে ধারণকৃত অসংখ্য গানের সংকলন। ছোটবে্লায় বাড়িতে ছুটির দিনে সারাদিন টেপ রেকর্ডারে নানান গান বাজতো –পঙ্কজ মল্লিক থেকে শুরু করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত নানা শিল্পীর গান শুনেছি। শ্যামা,চণ্ডালিকা—রবীন্দ্রনাথের এসব গীতিনাট্য বাড়িতে বেজেছে। আমার পাঁচ বছর বয়সে বিলেতে থাকতে বাবা নিজে আমাকে শ্যামার ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’ গানটি শিখিয়েছিলেন।
দেশে ফিরে একাধিকবার ডাক্তারদের সম্মিলিত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠানে মঞ্চে অভিনয় করেছেন ডাপটের সাথে, এবং মঞ্চাভিনয়ে ছাড়াও নাট্য নির্দেশনা, মেক-আপ, এসব বিষয়ে বেশ ভাল মুনসীয়ানা ছিল, সে তো আমার নিজের চোখেই দেখা।
তাঁর ছাত্রজীবনের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার থেকে যে এই সুকুমারবৃত্তি উৎসারিত, সেকথা তাঁর কাছ থেকেই শোনা। কখনও কখনো তার চাক্ষুস প্রমাণও পেয়েছি। একবারের কথা মনে পড়ছে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হবে। হঠাৎ করে আয়োজকরা বদরুল আলমকে খুব করে ধরলো, তাঁর ছাত্রজীবনে রচিত ‘এনাটমির জারি’ গাইতে হবে।
এসব ব্যাপারে বাবার উৎসাহ বরাবরই প্রচণ্ড, তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং বাসায় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। জারিগান গাইতে তো দল লাগে – এখন কোথাও পাওয়া যাবে সঙ্গী? আমাকে আর আমার ছোট দু’বোন কল্পনা আর আল্পনাকে এই কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো, হারমোনিয়ামে মা আফজালুননেসা।
বলা বাহুল্য – সেই গানের খটমট ডাক্তারি কথা আমরা তিন ভাইবোন কিছুই বুঝিনি, আরবী সুরা মুখস্থ করার মত আমরা শিখেছিলাম।
অনুষ্ঠানের দিন মেডিকেল কলেজের গ্যালারিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। আমরা – মূল গাইয়ে বদরুল আলম – সঙ্গে মা আর আমরা তিন ভাইবোন, গাইলাম এনাটমির জারি। উল্লাসে-আনন্দে-প্রশংসায় প্রচণ্ড করতালিতে হলকক্ষ কেঁপে উঠলো।
তখন অতটা খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন সেই এনাটমির জারির কথা ভেবে চমৎকৃত হই। গানটি ব্যঙ্গরসাত্মক, তবে সুর ও গায়কিতে জারিগানের চরিত্র সম্পূর্ণ অটুট। অথচ ছন্দ সম্পূর্ণ রক্ষা করে গানের কথায় এনাটমি পড়ার বিভীষিকার কথা এতো সরসভাবে বলা হয়েছে, যে ডাক্তারির সাথে জড়িত যে কেউ এই গানটি থেকে প্রভূত মজা পাবেন। পরে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে নিজের এনাটমি পড়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বলে আমিও এই গানের অর্থ যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম – বিশেষ করে হাজার পৃষ্ঠাধিক ভারি Gray’s Anatomy বইটাতো ছিল মূর্তিমান ত্রাস। গানটার ধুয়া ছিল এরকম – “কে বুঝিতে পারে তোমার ঠ্যালা, এনাটমি” আর প্রথম দিকের কয়েকটি চরণ এরকম “গ্রে নামে এক ডাক্তার ছিল লণ্ডন শহরে/ এনাটমি লিখবার তরে কষে কলম ধরে/ পাতার পরে পাতা লিখে পটল তুলিল/ এইভাবে এনাটমি দেশেতে আসিল/ দেশে দেশে ছড়াইল সাঙ্গপাঙ্গচেলারে এনাটমি কে বুঝিতে পারে তোমার ঠ্যালা —“
আরেক বারের কথা। সেটা সম্ভবত ৬০ দশকের শেষের দিককার কথা। আমার খালু প্রয়াত শিল্পপতি মোজাম্মেল হক তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে অবাঙ্গালীদের সাথে পাল্লা দিয়ে শিল্প স্থাপনার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করলেন – ঢাকার অদূরে ঘোড়াশালের পলাশে বাঙালীর উদ্যোগে স্থাপিত হলো জনতা জুট মিল – আর সেটা উদ্বোধন করলেন ভাষাবিদ ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। পরে ঢাকা থেকে আমাদের আত্মীয় স্বজনমিলে প্রায় শ’খানেক লোক গেলাম পলাশে মিল দেখতে। আমাদের আড়ম্বর করে সম্বর্ধনা দেওয়া হলো, এমন সময় কথা উঠলো – তাহলে আমরা যারা ঢাকা থেকে এসেছি, তাঁদেরও তো কোন একটা কিছু করা চাই। বিনাবাক্যে বদরুল আলমই নির্দেশনার দায়িত্ব পেয়ে গেলেন। এবার খোঁজ শুরু হয়ে গেল – কে গান গাইতে পারে, কে আবৃত্তি করতে পারে। আমার খালাতো বোন গীটার বাজায়, তার ডাক পড়লো। ঐ একদিনেই ভালভাবে মহড়া দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় মঞ্চে একটা ছিমছাম মনোজ্ঞ বিচিত্রানুষ্ঠান পরিবেশিত হলো। পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে অনুষ্ঠান, সুতরাং তা সর্বাঙ্গসুন্দর হয়নি অবশ্যই – কিন্তু বেশ গোছানো হয়েছিল। এর গ্রন্থনা ও নির্দেশনা বদরুল আলমের, মনে পড়ে স্বাধীনতার ইঙ্গিত তখনও আসেনি, অথচ বাবা আমার পারুল খালাকে দিয়ে আগ্রহভরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গাইয়েছিলেন।
বাবার সার্বিকভাবে বাংলা ও ইংরেজিতে ঈর্ষণীয় দখল ছিল। মঞ্চে বক্তৃতা বা স্মরণিকায় লেখালেখির কাজে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। টেলিভিশনে বারকয়েক শিশুরোগ বিষয়ে আলোচনা করেছেন – বাংলা বাচনভঙ্গি শব্দচয়ন রীতিমত সাহিত্যঘেঁষা ছিল।
আরেকটা জিনিস আমার ছোটবেলা থেকে দেখেছি। বদরুল আলমের আঁকার হাতটা ভাল ছিল। সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হবার সময়ে আমার ছোট চামড়ার সুটকেসে আমার নাম ক্লাস ইত্যাদি ইংরেজিতে লিখে দিয়েছিলেন – একদম পেশাদারী মানের। আমাদের বাড়িতে ছোটবেলার ছবি সম্বলিত একটি এলবাম ছিল সেই এলবাম সম্ভবত ৫০ দশকের শেষে সঙ্কলিত হয় – সেখানেও তার অলংকরণ ছিল অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। বাবা নানাজায়গায় শিল্প-সংস্কৃতির নানান কাজ করেছিলেন, তা এর-ওর কথা বা স্মৃতিচারণে আঁচ করতে পারলেও সেসব নিয়ে বাবা কিন্তু কখনই খুব একটা কথাবার্তা বলতেন না।
আমি তখন স্কুলবয়সী কিশোর – নানান বিষয়ে কৌতুহল – একবার বাড়ির পুরনো বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম কয়েকটি রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বাংলা বই। লেখক ‘কুয়াশা।‘ (খুব সম্ভবত ৫০ দশকে প্রকাশিত, এটি উত্তরকালের সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজ নয়, সেটা কাজী আনোয়ার হোসেন স্বনামেই লিখেছেন।) এই ‘কুয়াশা’ প্রয়াত দন্তচিকিৎসক আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের ছদ্মনাম। ইনি সুহৃদমহলে ‘মাস্তানা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনিও শিল্প সংস্কৃতির বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন, তার বেশ কিছু গান আজাদ রহমানের সুরে এক কালে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
সেই কুয়াশা রচিত রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের কয়েকটা বই গোগ্রাসে পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করলাম তাতে কোথাও কোথাও সচিত্রকরণ রয়েছে – এবং সেটা বদরুল আলমের করা। এসব রগরগে বইয়ে যেমনটা হয় – মুখোশ পরা এক আততায়ী এক মহিলাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হচ্ছে, এই ধরনের ছবি—কিন্তু আঁকার হাত একেবারে পাকা পেশাদারের – কোন উঁচুমানের সচিত্রকরণ শিল্পীর কাজের থেকে একেবারেই আলাদা করার জো নেই। নিজের বাবার এই গুণটির কথা জেনে খানিকটা গর্ব হয়েছিল সেটা মনে আছে – তবে এই বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করার দুঃসাহস দেখাইনি কারণ তাতে ক্লাসের পড়ায় ফাঁকি দিয়ে রহস্য উপন্যাস পড়ার জন্য কানমলা খাওার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
প্রথম শহীদ মিনার নিয়ে লেখালেখি
কখনো কখনো বন্ধুবান্ধব এলে দুই একবার হয়তো প্রথম শহীদ মিনারের কথা উঠতো—তার বেশি আলোচনা বদরুল আলম কে করতে দেখিনি। তখন সম্ভবত ৭০ দশকের মাঝামাঝি – সচিত্র সন্ধানী নামে একটা সাপ্তাহিক মাত্র বের হচ্ছে – কাইয়ুম চৌধুরীর অলঙ্করণে খুবই আকর্ষণীয়, লেখাটেখাও মন্দ নয়। সেটাতে প্রথম শহীদ মিনার নিয়ে বাংলার অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একটি প্রবন্ধ লিখলেন। লেখার আগে তিনি আমাদের সোবহানবাগের ফ্ল্যাটে এসে বাবার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন, এবং তাঁর প্রবন্ধে বাবার প্রথম শহীদ মিনারের নক্সা প্রণয়নের কথা বিস্তারিতভাবে লেখেন।
বদরুল আলমের ভাষ্য ছিল এই রকম – ১৯৫০ দশকে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সংগঠন ‘শিল্পী সংঘ’ শহরে নামকরা প্রতিষ্ঠান, তাঁদের নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে শহরের লোক ভীড় করতো। বদরুল আলম তখন মেডিকেল ছাত্র, এছাড়া শিল্পী সংঘের ঘনিষ্ট কর্মী – শিল্প সংস্কৃতির নানান দিকে বিশেষ করে অঙ্কন ও অলঙ্করণে তার প্রতিভা বন্ধুমহলে সুবিদিত।
১৯৫২ সালে পুলিশী গুলিতে কয়েকজন নিহত হবার পর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মেডিকেল কলেজের পলাশীর ছাত্রাবাস। বদরুল আলম কে বন্ধুরা ধরলো একটা শহীদ মিনারের নক্সা করে দেবার জন্য। রাতে বসে তিনি নক্সা করলেন, সেই নক্সা অনুসরণ করে রাতারাতি একটি শহীদ মিনার তৈরি হলো, এবং অসংখ্য নারীপুরুষ পরদিন সেখানে এসে সেখানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।
রফিকুল ইসলামের লেখা প্রকাশিত হবার পর তার প্রতিবাদ করে সাঈদ হায়দার একটি চিঠি লিখলেন – সেটা সচিত্র সন্ধানী ছাপলো। চিঠির বক্তব্য মোটামুটি এইরকম, বদরুল আলম নয়, প্রথম শহীদ মিনারের রূপকার বদরুল আলম নয়, সাঈদ হায়দার নিজেই।
আমার পরিষ্কার মনে আছে, এই চিঠি ছাপার অক্ষরে দেখে আমার বাবা প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছিলেন। তারপর সেটা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ কতটা কোথায় গড়িয়েছিল, সেটা আর আমার আজ মনে নেই।
প্রথম শহীদ মিনারের তাৎপর্য
আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় – আমাদের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। এই নিয়ে লেখালেখি কিছু কম হয় নাই – তার মধ্যে বদরুদ্দিন উমরের তিন খণ্ডের পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ভাষা আন্দোলনের নানান বইপত্র ঘেঁটে আমার মনে হয়েছে, যে বেশির ভাগ বইয়ে প্রথম শহীদ মিনারে বদরুল আলমের যে ভূমিকা ছিল সেটা স্বীকার করা হলেও তিনিই যে প্রথম নক্সাটা করেন সেইটা খুব স্পষ্টভাবে সবখানে বলা হয় না।
আগেই বলেছি, এই নিয়ে আমার মায়ের আক্ষেপের শেষ নেই। আমার বক্তব্য একটু স্বতন্ত্র – বিতর্ক যখন উঠেছেই, তখন সকল পক্ষের থেকে যথাসাধ্য প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহ করে নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি বিচার করে একটি যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন – সেটা বদরুল আলমের পক্ষে বা বিপক্ষে যেদিকেই যাক না কেন। তবে বদরুল আলমের পক্ষে সে সময়ের একাধিক মেডিকেল ছাত্র বক্তব্য রেখেছেন, এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ডাঃ মূর্তজা তাঁর একটি বইয়ে এই বিষয়ে শুধুমাত্র তাঁর নাম উল্লেখে করেছেন, একথা সত্যি।
গোটা ভাষা আন্দোলনে শুধু বদরুল আলমই নয়, প্রথম শহীদ মিনারের একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আন্দোলন যে শুধুই রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, শুধুমাত্র গুটিকয়েক আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবি নয়—এ যে সর্বসাধারণের প্রাণের দাবি, এই বিষয়টি প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনা এবং তার প্রতি অসংখ্য মানুষের প্রাণঢালা অর্ঘ্য প্রথমবারের মতো স্পষ্ট করে দেয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ যে প্রচণ্ড ধিক্কারের জন্ম দিয়েছিল,সেটা বাংলা ভাষার রাজনৈতিক অধিকারের দাবিকে সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত করে,আর সেই অগ্নিগর্ভা যুগসন্ধিক্ষণেই প্রথম শহীদ মিনারের সৃষ্টি।
বদরুল আলম সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, কিন্তু একেবারেই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।কিন্তু একুশের গুলিবর্ষন তাকেও উজ্জীবিত করে। তখন শহীদের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে তিনি দ্বিধা করেন নাই, রাত জেগে নক্সা প্রণয়ণ করে স্বৈরাচারী সরকারের ওপর গণমানুষের ক্রোধ, আর নিহত শহীদদের প্রতি, নিজের ভাষার প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের প্রতীক গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ইতিহাসে এই রকম একেকটা মূহুর্ত আসে, যখন রাজনৈতিক আন্দোলন আর মুষ্টিমেয় রাজনীতিসচেতন কর্মীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না – তা সর্বস্তরের জনতার মাঝে সঞ্চারিত হয়ে তাকে দুর্দম শক্তিতে এমন তেজোদ্দীপ্ত করে তোলে যে সেই দাবি আর আন্দোলনের উত্থানকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কোন স্বৈরাচারী শক্তিরই আর থাকে না।
অতি অধুনা আরব বিশ্বে এরকম একাধিক পরিস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।কায়রোর তাহরীর স্কোয়ারের অগণিত মানুষের দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে হোস্নি মুবারককে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও অত্যাচারের পর গণজোয়ারে মহাপরাক্রমশালী স্বৈরশাসন ঘরকুটার মতো ভেসে গেছে।
তিউনিসিয়ার সেই ক্ষুব্ধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর আগুনে আত্মাহুতি যেভাবে তিউনিসিয়া তথা গোটা আরববিশ্বে স্বৈরাচারী শাসকদের গদি টালমাটাল করে দেয়, তেমনি আমাদের দেশে ১৯৫২ সালে ক্ষুব্ধ গণজোয়ার ঘোষণা করে বাংলা ভাষায় বাঙালি আপোষ করবে না – আর তার প্রথম, দ্যোতনাময় ইঙ্গিত পাই এই প্রথম শহীদ মিনারে – সেখানে বদরুল আলম ছিলেন, ছিলেন কোন অজ্ঞাতনামা ঠিকাদার যিনি বিনামূল্যে প্রথম মিনারের রসদ সরবরাহ করেছিলেন, ছিলেন সেসব কর্মী যারা সারা রাত্রি জেগে শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন – আর ছিলেন কত নাম-না-জানা মানুষ, যারা পরে এসে সেখানে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
আমাদের ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ মিনার তাই একটা আলাদা, গৌরবোজ্জ্বল তাৎপর্য বহন করে, আলাদা করে স্মরণ করার দাবি রাখে।
কোন নিষ্ঠাবান ঐতিহাসিক গবেষক ভাষা আন্দোলেনের এই তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়টির বিস্তারিত ঐতিহাসিক বিবরণ প্রস্তুত করতে এগিয়ে আসবেন কি?
আশফাক স্বপন, লেখক ও অনুবাদক
[লেখক পরিচিতিঃ আশফাক স্বপন দুই দশকের বেশি সময় ধরে মার্কিন দেশের অভিবাসী সংবাদপত্রে লেখালেখি সম্পাদনা করেছেন। কয়েক বছর ধ’রে ঢাকার Daily Star-এ নিয়মিত কলাম লেখেন। তার অনুবাদ নিয়মিতভাবে ঢাকার ‘কালি ও কলম’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।]
আপনার মতামত জানানঃ