পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি? কল্পবিজ্ঞান কাহিনি ও চলচ্চিত্রে অন্য গ্রহের প্রাণী নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে৷ আমাদের সৌরজগত ও দূরের নক্ষত্র জগতের কিছু অংশে প্রাণের উপযুক্ত পরিবেশ চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা৷
পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহ কি মানুষের বসবাসের যোগ্য? আমাদের এই পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য জীববৈচিত্র্য দেখা যায়, যা জীবন সম্পর্কে আমাদের ধ্যানধারণা গড়ে তুলেছে৷ উন্নতি, বিকাশ ও এগিয়ে চলার জন্য কী প্রয়োজন, সেই উপলব্ধিও আমাদের মনে জন্মায়৷
প্রাণের স্পন্দনের জন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যের প্রয়োজন৷ সূর্যের উত্তাপের অপরিবর্তিত মাত্রা লাখ লাখ বছর ধরে স্থিতিশীল এক পরিবেশ নিশ্চিত করেছে৷ তাছাড়া পৃথিবী নির্দিষ্ট এক দূরত্ব বজায় রেখে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে৷ সেই স্থিতিশীল উত্তাপের কারণে পৃথিবীর উপরিভাগে সব সময়ে তরল পানি পাওয়া যায়৷ আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী পানিই প্রাণ সৃষ্টির পূর্বশর্ত৷
কোনো নক্ষত্রের কাছে নির্দিষ্ট একটি দূরত্ব পর্যন্ত এলাকায় কোনো গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি হতে পারে৷ আমাদের পৃথিবী সেই সীমানার ভিতর দিকে থাকলে পানি গরম হয়ে বাষ্পে পরিণত হতো৷ অন্যদিকে সীমানার বাইরের দিকে গেলে সব পানি বরফ হয়ে উঠতো৷
পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে— এই অনন্ত জিজ্ঞাসা মানুষের। বিশেষ করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। আসলে মহাবিশ্বের তুলনায় সৌরজগৎ কিছুই না, একেবারে বালিকণার মতো। আর সে তুলনায় পৃথিবী তো আরো অনেক ছোট। এই মহাবিশ্বের অনেক কিছুই এখনও অজানা। অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে বহুকিছু। অধরা রয়ে গেছে মহাবিশ্বের অনেক রহস্যও। আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতায় অচেনা রয়ে গেছে অনেক বিস্ময়কর জগৎ। কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানীরা থেমে নেই। নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে তারা রহস্যভেদ করতে চাইছেন অজানা মহাবিশ্বের।
সৌরজগতের বাইরে নতুন কিছু গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেখানে জীবনের উপযোগী পরিবেশ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি পৃথিবী থেকে বহু আলোক-বর্ষ দূরের এসব গ্রহের খোঁজ পেয়েছেন। খবর বিবিসি
সদ্য আবিষ্কৃত এসব গ্রহকে বলা হয় ‘হাইসিয়ান এক্সোপ্লানেট। সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে যেসব গ্রহ আবর্তিত হচ্ছে সেগুলোকে বলা হয় এক্সোপ্লানেট। আর হাইসিয়ান কথাটি এসেছে হাইড্রোজেন এবং ওশান— এই শব্দ দুটোর সংমিশ্রণে। অর্থাৎ যেসব গ্রহে হাইড্রোজেন ও সমুদ্র আছে সেসব গ্রহকে বলা হয় হাইসিয়ান প্ল্যানেট।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হিসেব অনুসারে এখনও পর্যন্ত চার হাজারের মতো এক্সোপ্লানেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। নাসার বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলেন, প্রত্যেকটি সৌরমণ্ডলে প্রায় এক ট্রিলিয়ন সূর্য আছে। আর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সৌরজগৎ আছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন। ফলে এই মহাবিশ্বে এক ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়নের মতো সূর্য আছে। অংকের হিসেবে এটা লিখতে গেলে ১ লিখে তার পাশে ২৪টি শূন্য বসাতে হবে। ফলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কতো বৃহৎ সেটা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।
এসব সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আরো অগণিত গ্রহ। এগুলোকে বলা হয় এক্সোপ্লানেট। সৌরজগতের বাইরের এসব গ্রহ সম্পর্কে এখনও খুব বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে কিছু কিছু এক্সোপ্লানেট শুধু দেখা যায়। কোনো গ্রহ যখন সূর্যের সামনে দিয়ে যায় তখনই সেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। এসব গ্রহ কতো দূরে অবস্থান করছে সেটাও জানা যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে এধরনের গ্রহ নিয়ে ১৯৯০’র দশক থেকে গবেষণা শুরু হয়েছে। ড. অমিতাভ ঘোষ বলেন, আমাদের সৌরজগতে যেসব গ্রহ আছে সেগুলোতে হয় মিশন পাঠানো হয়েছে বা সেগুলোর পাশ দিয়ে আমরা উড়ে গেছি। তাই এগুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এক্সোপ্লানেট সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে এসব গ্রহ কী দিয়ে তৈরি, সেখানে কী ধরনের উপাদান আছে এসব বিষয়ে ধারণা করা যেতে পারে। তা না হলে শুধু ভিজ্যুয়ালি দেখা যাবে যে একটা কিছু আছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের খোঁজ পাওয়া এসব গ্রহ হচ্ছে হাইসিয়ান প্লানেট অর্থাৎ এসব গ্রহ সমুদ্র দিয়ে পরিবেষ্টিত এবং সেখানকার বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেনের উপস্থিতি রয়েছে।
যেহেতু এসব গ্রহে সমুদ্র আছে সেকারণে সেখানে জীবনের সম্ভাবনা আছে কীনা তা নিয়ে সম্ভাবনা দেখা গেছে। মহাকাশ বিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ বলছেন, জীবনের জন্য পানির প্রয়োজন, পানি ছাড়া জীবন হয় না এটা আমাদের একটা হাইপোথেসিস। কিন্তু এই হাইপোথেসিস ভুলও হতে পারে। কারণ আমরা একটা জীবনের বাইরে অন্য কোনো জীবন দেখিনি।
তার মতে, যেহেতু এসব গ্রহে পানি আছে, আমরা বলতে পারি যে সেখানে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ আছে। অর্থাৎ যদি জীবন থাকে সেটা বাঁচতে পারবে মারা যাবে না।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রের তলদেশে যেখানে সূর্যের আলো গিয়ে পৌঁছায় না সেখানেও জীবনের অস্তিত্ব আছে। সেখানে ফটো-সিনথেটিক জীবনের উপযোগী পরিবেশ নেই। কিন্তু আরেক রকমের জীবন থাকতে পারে যারা রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে জীবনের শক্তি অর্জন করতে পারে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের আবিষ্কৃত বেশিরভাগ গ্রহই আকারে পৃথিবীর চেয়ে বড় এবং আরো বেশি উষ্ণ। এই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এসব গ্রহের কোনো কোনোটির একপাশে স্থায়ীভাবে অন্ধকার। সেখানে কখনো দিন হয় না। কিন্তু অন্যপাশে স্থায়ীভাবে আলোকিত। অর্থাৎ গ্রহটির ওই অংশে কখনো রাত হয় না। এর পেছনে কারণ হচ্ছে— পৃথিবী যেমন নিজেই নিজের চারদিকে ঘোরে এসব গ্রহ সেরকম ঘোরে না।
কিন্তু এই দুটো অংশ বাদে যে অংশটি ছায়া ছায়া, অর্থাৎ যেখানে আলো এবং অন্ধকার দুটোই আছে সেখানে জীবনের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ এগুলো তাদের যে নক্ষত্রের চার পাশে আবর্তিত হয় তার খুব কাছাকাছি।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. নিককু মধুসুধান। তিনি বলেছেন, তাদের এই আবিষ্কারের ফলে মহাকাশের অন্যত্রও যে জীবন থাকতে পারে সেবিষয়ে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।
এর আগে সৌরজগতের বাইরে আরো যেসব গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোতে হাইড্রোজেন-সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলে চাপ এবং তাপমাত্রা খুব বেশি বলে ধারণা করা হয়। ফলে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা কঠিন। কিন্তু সম্প্রতি যেসব গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন সেগুলোতে যে ধরনের পরিবেশ রয়েছে সেটা জীবনের উপযোগী।
গবেষকরা বলছেন, এসব গ্রহ পৃথিবীর চেয়ে আড়াই গুণ বড় এবং এসবের তাপমাত্রা ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। তবে সেসব গ্রহে যেসব সমুদ্র আছে তার পরিবেশ অনেকটা পৃথিবীর সমুদ্রের মতোই। তাই যেসব গ্রহে সমুদ্র আছে সেগুলোতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যাবে না।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব এক্সোপ্লানেট কতো দূরে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলোর অবস্থান আমাদের পৃথিবী থেকে ৩৫ থেকে ১৫০ আলোক-বর্ষ দূরে। শত শত বছর ধরে মানুষ যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে তা হলো- এই মহাবিশ্বে আমরাই কি একমাত্র মানুষ, নাকি অন্য কোনো গ্রহে আমাদের মতো আরো কেউ আছে?
থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি কেউ না থাকে তাহলে বলতে হবে এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হচ্ছে মহাজাগতিক এক ঘটনা। কিন্তু যদি কেউ থাকে তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে তাদের সঙ্গে আমাদের কখনও দেখা হয়নি কেন? নাসার বিজ্ঞানী ড. অমিতাভ ঘোষ বলেন, মহাকাশযানের সীমাবদ্ধতা এবং মানুষের আয়ু এর একটা বড় কারণ।
আমরা যেসব মহাকাশ যান তৈরি করেছি সেগুলো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আকারের তুলনায় খুবই ধীর গতির। ১৯৭৬ সালে ভয়েজারের যাত্রা শুরু হয়। এটি এখন সৌরজগতের কিছুটা বাইরে যেতে পেরেছে। তবে সৌরজগতের শেষ কোথায় তার সংজ্ঞা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। গত ৪৫ বছরে সেখানে যেতে আমাদের সময় লেগেছে এক আলোক-দিবস। কিন্তু সবচেয়ে কাছের সূর্য হচ্ছে চার আলোক-বর্ষ দূরে।
তাহলে ভেবে দেখুন যে সেখানে যেতে আমাদের লাখ লাখ বছর লাগবে। এটা আমাদের মিল্কি ওয়ের ভেতরেই। কিন্তু আপনি যদি অন্য কোনো সৌরজগতে যেতে চান সেটি তো কোটি কোটি আলোক-বর্ষ দূরে। আমরা কি এতো বছর বেঁচে থাকবো? তিনি বলেন, সৌরজগতের বাইরের কোনো গ্রহে যেতে হয়তো দুই কোটি বছর লাগবে। এতো লম্বা সময় তো মানবজাতি নাও বাঁচতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ