বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার হার ক্রমশ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে নারী-শিশু পাচারও। আর এর নেপথ্যে রয়েছে দেশীয় দালাল চক্র। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সারাদেশে সক্রিয় এ চক্রটি। প্রশাসনের নজর এড়িয়ে দেশীয় ও রোহিঙ্গা দালাল সিন্ডিকেট নারী-শিশু পাচারের পাশাপাশি যৌন পেশায় ঠেলে দিচ্ছে অধিকাংশ যুবতী নারীদের।
কেউ ইচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায় জড়াচ্ছেন এই পেশায়। কক্সবাজারের কিছু সস্তা হোটেলে রোহিঙ্গা মেয়েরা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। খদ্দেরপ্রতি রেট পাঁচশ’ টাকা। তবে এই টাকার মধ্যে সত্তর টাকার মতো যৌনকর্মী পান। সেই টাকা আবার অনেক সময় সরাসরি তার কাছে পৌঁছায় না। বরং তার আত্মীয়স্বজন কেউ সেটা নিয়ে যান।
কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলায় এখন প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছেন। এত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী যেখানে, সেখানে নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার শঙ্কা থেকেই যায়। নিরাপত্তা বাহিনী চেষ্টা করছে, শরণার্থীরা যাতে শিবির ছেড়ে অন্যত্র যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে। এজন্য শরণার্থী শিবিরগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। মানবপাচার রোধ এ সব চৌকির অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু তবুও বাড়ছে রোহিঙ্গা যৌনকর্মী, বাড়ছে নারী শিশু পাচার।
গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫৪ জন রোহিঙ্গা নারী পাচারের সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আটক হয়। মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক বানিয়ে বিদেশে পাচার করে যৌন কর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হয় এ সব রোহিঙ্গা নারীদের।
গত ১৪ মে কক্সবাজারের আবাসিক হোটেল থেকে উদ্ধার করা হয় ১৭ জন তরুণীকে। উদ্ধারের পর তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কক্সবাজার ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুদের উদ্ধার করা হচ্ছে।
গত ২০ জুলাই ঢাকা থেকে দুই রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় দালাল চক্রের সদস্যদেরও আটক করা হয়। বাংলাদেশি পাসপোর্টের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের চেষ্টা করছিল দালালরা। এর আগে সিলেট থেকে ১৪ জন রোহিঙ্গা নারী শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ।
কক্সবাজারে যৌন কর্মীদের নিয়ে কাজ করে নোঙর নামের একটি এনজিও। রোহিঙ্গা নারীদের যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তারা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে।
নোঙরের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, ‘স্থানীয় দালাল চক্র ছাড়াও আগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে তরুণীদের নানা উপায়ে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে। হতদরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করছে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় দালাল চক্র’।
নোঙরের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘চাকরির নামে বিদেশে যাদের পাচার করা হয় মূলত তাদের যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়ার পরিবেশ তৈরি করে পতিতা বানানো হয়। যেভাবে উদ্ধারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতেই প্রমাণ হয় নারী শিশু পাচার ও যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত কি পরিমাণ রোহিঙ্গা তরুণী এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বিয়ের প্রলোভনে পড়ে, অর্থ লোভে, নেশাগ্রস্ত হয়ে অনেক রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারী দালালের খপ্পরে পড়ে যৌন পেশাকে বেছে নিয়েছে। ঠিকানা পাল্টিয়ে অনেক রোহিঙ্গা তরুণী কক্সবাজার, চট্রগ্রাম শহর ছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ভাড়া বাসায় বসবাস করে বিভিন্ন হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস, রেস্ট হাউসে উঠে দালালের মাধ্যমে ভাড়া খাটছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
তবে কতজন রোহিঙ্গা নারী যৌন কর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও বেসরকারি একাধিক সংস্থার মতে এ সংখ্যা ২৫-৩০ হাজার হতে পারে বলে জানা গেছে।
আর শুধু কক্সবাজারই নয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের আশেপাশের জঙ্গলে, পাহাড়েও দেহব্যবসা চলে বলে জানিয়েছেন একাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী। অনেকে সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করেন। কেননা, কারো কারো কাছে নগদ টাকা আয়ের অন্যতম উৎস এটি।
কক্সবাজারের এসপি হাসানুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা তরুণীরা যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে এটা সত্য। কারণ বিভিন্ন সময় পুলিশ অভিযান চালিয়ে খদ্দেরসহ রোহিঙ্গা তরুণীদের আটক করে। জেলা ডিবি পুলিশ শহরের কলাতলী, লালদিঘি পাড়সহ চিহ্নিত কতগুলো হোটেলে শত শত যৌনকর্মীকে প্রায় সময় আটক করে। এর মধ্যে ৭০ ভাগ হচ্ছে রোহিঙ্গা তরুণী। দলে দলে ক্যাম্প ছাড়ছে রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুরা। তবে কী কারণে এত বিপুল সংখ্যক লোক ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে এর সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বিয়ের প্রলোভনে পড়ে, অর্থ লোভে, নেশাগ্রস্ত হয়ে অনেক রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারী দালালের খপ্পরে পড়ে যৌন পেশাকে বেছে নিয়েছে। ঠিকানা পাল্টিয়ে অনেক রোহিঙ্গা তরুণী কক্সবাজার, চট্রগ্রাম শহর ছাড়াও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ভাড়া বাসায় বসবাস করে বিভিন্ন হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস, রেস্ট হাউসে উঠে দালালের মাধ্যমে ভাড়া খাটছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
অনেকের ধারণা বাংলাদেশের জনস্রোতে মিশে গিয়ে জন্ম সনদ সংগ্রহ এবং কোনো মতে ভোটার আইডি কার্ড করা গেলে এ জীবনে আর মায়ানমারে যেতে হবে না। তাই এত দৌড় ঝাপ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুদের। বিনিময়ে নারীরা পাচার হোক বা বেশ্যা হোক কিছুই আসে যায় না।
কক্সবাজারে এইডসের ভয়াবহ বিস্তার
কক্সবাজারে ভয়াবহভাবে বিস্তার ঘটছে মরণব্যাধি এইডসের। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এইডস রোগের বিস্তার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও রয়েছে এইডস ঝুঁকিতে। পেশাদার-অপেশাদার যৌনকর্মী ও মাদকাসক্তদের অবাধ যৌনাচারের কারণে ছড়াচ্ছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এইচআইভি নিয়ে কাজ করা একজন এনজিও কর্মী জানান, ‘তাদের কাছে তথ্য রয়েছে কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউসে ৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা তরুণীর যাতায়াত। তারা অনিরাপদভাবেই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও স্থানীয়দের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করছে। এতে কক্সবাজারে এই রোগ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গা যৌনকর্মী ছাড়াও পর্যটন শহর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে যৌনকর্মীদের ব্যাপকহারে কক্সবাজার আগমনও এইডস বিস্তারের আরেকটি অন্যতম কারণ।
এইচআইভি নিয়ে কাজ করা এনজিওদের কাছ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে জেলায় রোহিঙ্গা ছাড়াও স্থানীয় ২ হাজারের মতো যৌনকর্মী রয়েছেন। যাদের বেশিরভাগের এইচআইভি সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণা নেই। ফলে তাদের মধ্যে কতজনের শরীরে এইচআইভি ভাইরাস রয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও সমকামীদের বিষয়টি অনেকেই জানে না অথবা জানলেও লজ্জায় অনেকেই মুখ খুলে না বলেও জানা যায়।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুল মতিন বলেছেন, ‘কক্সবাজার এইডসের জন্য এখন বিপদজনক এলাকা। তিনি জানান, রোহিঙ্গারা যে হারে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সে তুলনায় শনাক্ত করা হচ্ছে কমই। প্রকৃত অর্থে আক্রান্তের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।
থেমে নেই শিশু-কিশোরী পাচার
করোনাকালেও থেমে নেই শিশু-কিশোরী ও রোহিঙ্গা পাচার। পাচারকারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদেরকেই পাচারের জন্য টার্গেট করে। গত কয়েক বছরে পাচারের ক্ষেত্রে ফেসবুক, টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের মানব পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই নারীদের বেশির ভাগকে জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের অন্তত ৩০টি জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত আছে। ফলে এসব সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশু পাচারের নিয়মিত ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে টিকটকের মাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে কিশোরীদের ভারতে পাচারের ঘটনা উঠে এসেছে। নারী পাচারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে গত মাসের শেষ দিকে ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। এ ঘটনায় ভারতের পুলিশ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে রয়েছেন ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়।
এদিকে ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব নারী পাচারে জড়িত দুটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। শুধু এই দুই চক্র পাঁচ বছরে প্রায় ২ হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে পুলিশ ও র্যাব দাবি করেছে।
তবে বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয় তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ দাবি করেছে, বছরে এই সংখ্যা ৫০ হাজার। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সংখ্যার সত্যতা নিয়ে কখনো কিছু বলা হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মানব পাচারের যেসব মামলা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, প্রায় ২ হাজার নারী মানব পাচারের শিকার হয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২০ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত নারীর সংখ্যা ৩০৩ জন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ