ধর্মের কথা বলে ১০ হাজার গ্রাহকের পাঁচহাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও সাবেক এমএলএম কর্মী ও মসজিদের ইমাম রাগীব আহসান। জমা দেয়া টাকা ফেরত পেতে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করেছেন গ্রাহকরা, কিন্তু কার্যালয় বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে গেছেন এহ্সান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মুফতি রাগীব আহসান। তার অন্য কর্মীদেরও হদিস মিলছে না। এমন বাস্তবতায় গচ্ছিত টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত গ্রাহকরা। এ নিয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাইছে তারা।
জানা যায়, ২০০৮ সালে মাত্র ৯০০ টাকা বেতনে এহসান মাল্টিপারপাস নামক একটি প্রতিষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসেবে চাকরি করতেন মুফতি রাগীব আহসান। এহসান মাল্টিপারপাস দেউলিয়া হলে একই নামে নতুন কোম্পানি চালু করেন রাগীব। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পিরোজপুর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন এহসান গ্রুপ। আর এ কাজে ব্যবহার করেন ধর্মীয় লেবাস। বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল এবং ধর্মীয় জলসার আয়োজন করে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের গ্রুপে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী হিসেবে বাছাই করতেন বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকদের। প্রায় ছয়শ ফিল্ড অফিসার (এফও) এবং লক্ষাধিক গ্রাহকের থেকে টাকা নিয়ে তৈরি করেন ১৭টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুমানিক মূলধন পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
পিরোজপুর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন এহসান গ্রুপ। আর এ কাজে ব্যবহার করেন ধর্মীয় লেবাস। বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল এবং ধর্মীয় জলসার আয়োজন করে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের গ্রুপে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী হিসেবে বাছাই করতেন বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকদের।
ব্যবসার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা মাঠকর্মী এবং বিনিয়োগকারীদের। তবে সম্প্রতি একের পর এক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরিয়ে ফেলা হয় টাকা। জেলা প্রশাসনের তদন্তেও দেখা যায় এহসান গ্রুপের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেই টাকা। এ নিয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা কয়েক দফা মানববন্ধন, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলেও ফল জোটেনি।
স্থানীয়রা জানান, ১৩ থেকে ১৪ বছর আগে একটি মসজিদে নামমাত্র বেতনে ইমামতি করতেন মুফতি রাগীব আহসান। পরে ইমামতি ছেড়ে কাজ নেন একটি এমএলএম কোম্পানিতে। সেখানকার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন এহ্সান রিয়েল এস্টেট। এখন এর নাম এহ্সান গ্রুপ পিরোজপুর। এ গ্রুপের অধীনে রাগীব গড়ে তোলেন ১৭ টি প্রতিষ্ঠান।
ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্মভীরু লোকজনের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা।
গ্রাহকদের বলা হয়, এক লাখ টাকার বিপরীতে মাসে দুই হাজার টাকা মুনাফা দেয়া হবে।
এভাবে ১০ হাজার জনের কাছ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা নেয়া হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী দাবি করা গ্রাহকদের।
ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় প্রতিমাসেই বিভিন্ন ইসলামি জলসার আয়োজন করতেন মুফতি রাগীব। এ ছাড়া বছরে কয়েকবার আয়োজন করতেন ওয়াজ মাহফিলের। এসব অনুষ্ঠানে রাগীবের পছন্দের বক্তারা এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করার অনুরোধ করতেন। মানুষকে আকৃষ্ট করতেন ইসলামি শরিয়াহ অনুসারে নানারকম ব্যবসার বিষয়ে । সাধারণ মানুষ এতে সহজেই আকৃষ্ট হতেন। বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করতেন লাখ লাখ টাকা।
মাঠকর্মীরা গ্রাহকের থেকে এসব টাকা সংগ্রহ করতেন। তবে এখন অনেক মাঠকর্মীই বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন না। ঘরছাড়া এসব মাঠকর্মীর বেশিরভাগই বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম। গ্রাহকদের থেকে লভ্যাংশের কথা বলে টাকা এনে জমা দিয়েছিলেন এহসান গ্রুপে। এখন গ্রাহকরা টাকা ফেরত চাইলেও খোঁজ মিলছে না এহসান গ্রুপের কর্ণধারদের। রাজধানী ঢাকা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন তারা।
গ্রাহকরা আরো অভিযোগ করে বলেন, প্রতারক রাগীব আহসান বর্তমানে আত্মগোপনে থাকলেও তিনি ঠিকই বাংলাদেশে আছে। পুলিশ-প্রশাসন চাইলেই অভিযান চালিয়ে ধরতে পারে। কেন প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সেটা নিয়ে হতাশ তারা। এদিকে নিজেদের গচ্ছিত টাকা না পেয়ে অসহায় ভুক্তভোগী মানুষগুলোর মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক।
এহ্সান গ্রুপের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সমবায় অধিদফতর থেকে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে অনিয়ম ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা সমবায় অফিসার মো. মুজিবুল হক।
এদিকে এহসান গ্রুপের জালিয়াতির এ বিষয়টি তদন্তে ধরা পড়েছে বলে জানান প্রশাসনের করা তদন্ত কমিটির সদস্য ও পিরোজপুর প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মুনিরুজ্জামান নাসিম আলী ।
তবে সমবায় দফতর থেকে নেয়া লাইসেন্সের শর্ত ভঙ করে আমানত সংগ্রহ করায় তা গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন। পাশাপাশি জনগণকে তাদের সঙ্গে লেনদেন না করার আহ্বানও জানান তিনি।
তবে অভিযোগের বিষয়ে এহসান গ্রুপের কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের জোর দাবি সরকার তাদের গচ্ছিত রাখা টাকা ফিরিয়ে দিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্মের নামে সহজ সরল মানুষদের ঠকানো এ নতুন নয়। ওয়াজিরা সহজ সরল মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গোছান। এতে না আছে ধর্মের প্রতি তাদের কোনো অনুরাগ না আছে অসহায় মানুষদের প্রতি মমত্ববোধ। সহজ সরল মানুষেরা ধর্মের নামে দুর্বল বলে তাদের সেই অবস্থানটাকে ব্যবসা হিসাবে ব্যবহার করছে ধর্মীয় লেবাসধারী প্রতারকরা। তাদের আইনের আওতায় এনে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কষ্টের জমানো টাকা ফিরিয়ে দিতে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ