ওয়াজের মাধ্যমে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজেদের পরিচালনা করে থাকেন। ওয়াজে মুফতি মওলানারা যা বলেন, তাই সত্য হিসেবে মেনে নেয়া মানুষের কমতি নেই এ দেশে। এরই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এহসান গ্রুপের (এহসান এস) চেয়ারম্যান রাগীব আহসান বিনিয়োগের মাধ্যমে সুদবিহীন উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে মানুষকে আকৃষ্ট করতেন। বিদেশ থেকে আলেম এনেও প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি।
ধর্ম পুঁজি করে গ্রাহকদের আমানতকৃত ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার দায়ে পিরোজপুরের মাল্টিপারপাস কোম্পানি এহসান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাগীব আহসান (৪০) ও তার তিন ভাই আবুল বাশার (৩৫), মাহমুদুল হাসান (৩০) ও মো. খাইরুল ইসলামকে (২৮) সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।
আজ সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পিরোজপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মহিউদ্দীন এ আদেশ দেন।
মামলার এজাহার সূত্র ও সরকারী কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট খান মো. আলাউদ্দিন এক জাতীয় দৈনিককে জানান, পিরোজপুর সদর উপজেলার রায়েরকাঠী এলাকার মো. হারুন-অর-রশিদ বাদী হয়ে গত ০৯ সেপ্টেম্বর রাগিব আহসানের পরিচালনাধীন এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডের জমা ভাউচার মূলে (বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে আনা) অধিক মুনাফার প্রলোভনে বিভিন্ন মেয়াদে ৯১ কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৩ টাকা জমা দেন। পরবর্তীসময়ে তারা মুনাফাসহ জমাকৃত টাকা ফেরত না দিয়ে বিভিন্ন সময় টালবাহানা করতে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আলেমদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন রাগীব। পিরোজপুর, যশোর, নড়াইল, কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সক্রিয় এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করে এক হাজার ২০০ মাঠকর্মী এবং লক্ষাধিক গ্রাহক বিপাকে পড়েছেন।
উল্লেখ্য, প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার রাগীব হাসান ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। পরে ঢাকার একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিতে কাজ নেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই গড়ে তুলেন এহসান গ্রুপ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি। সেখানে নিয়োগ দেন জেলাসহ জেলার পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট, ঝালকাঠী, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার মসজিদের ইমাম, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালীদের।
প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার রাগীব হাসান ছিলেন একটি মসজিদের ইমাম। পরে ঢাকার একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিতে কাজ নেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই গড়ে তুলেন এহসান গ্রুপ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি। সেখানে নিয়োগ দেন জেলাসহ জেলার পার্শ্ববর্তী বাগেরহাট, ঝালকাঠী, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলার মসজিদের ইমাম, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালীদের।
তারা মাহফিলের মাধ্যমে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক অধিক মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ শুরু করেন। এ সংগৃহীত আমানত দিয়ে ২০০৮ সালে পিরোজপুর পৌরসভার খলিশাখালী এলাকায় এহসান রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড বিল্ডার্স প্রতিষ্ঠা করেন রাগীব। এরপর পৌর শহরের সিও অফিস মোড় সংলগ্ন এলাকায় জমি কিনে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। যা ‘এহসান গ্রুপ’ নামে পরিচিতি। ওই এহসান গ্রুপ নামে ১৭টি প্রতিষ্ঠান খুলে প্রায় ২২ হাজার কর্মীর মাধ্যমে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেন। আর এসব আমানতের বিপরীতে প্রতি লাখে ২ হাজার টাকা করে ব্যবসায়ীক লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় সংস্থাটি।
প্রতারক রাগীবের ১৭টি প্রতিষ্ঠান হলো— এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহ্সান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার ও এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।
এদিকে এহসান গ্রুপের প্রতারণা প্রকাশ হয়ে পড়ার পর এখন তোপের মুখে পড়েছেন সাধারণ কর্মীরা। আর গা-ঢাকা দিয়েছেন প্রতারক চক্রের ওই সব জামায়াতপন্থী।
অন্যদিকে র্যাব ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ধর্মকে ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা বিনিয়োগের নামে আত্মসাতের কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন রাগীব। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর তোপখানা এলাকা থেকে ভাই আবুল বাশার খানসহ তাকে গ্রেপ্তারের পর পিরোজপুর পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। পিরোজপুর থানায় রাগীব ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। পিরোজপুরের পুলিশ বৃহস্পতিবারই রাগীবের অপর দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খায়রুল ইসলামকে তাদের নিজ গ্রাম খলিশাখালী থেকে গ্রেপ্তার করে। আদালতের নির্দেশে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের সূত্র বের করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটির’ সাধারণ সম্পাদক যশোরের বারান্দীপাড়া কদমতলার মফিজুল ইসলাম ইমন জানান, কার্যত ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। পর্যায়ক্রমে এহসান সোসাইটি ও এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নাম নিয়ে যশোরে তাদের প্রতারণা শুরু হয়। মূলত এহসান এস বাংলাদেশ, এহসান রিয়েল এস্টেট ও এহসান মাল্টিপারপাস শরিয়া মোতাবেক সুদবিহীন ব্যবসার ধুয়া তুলে মাসে এক লাখে ১৬০০ টাকা মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা জমা নিতে থাকে। এই কাজে যশোরের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ সরল বিশ্বাসে এখানে লগ্নি করে।
ফেসবুকে এহসান গ্রুপের নামে ওয়াজের বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে ওয়াজকারীরা এহসান গ্রুপে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রাহক ও কর্মীরা বলছেন, শরিয়াসম্মত বিনিয়োগের এই আহ্বানে তারা অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন।
বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের কোটি কোটি লগ্নি হিসেবে হাতিয়ে নিলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী লভ্যাংশ বা আসল ফেরত দেওয়া হয়নি। আজ দেব কাল দেব বলে টালবাহানা শুরু করলে বিপাকে পড়েন লগ্নিকারীরা। এক পর্যায়ে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে গাঢাকা দেন এহসান এসের কর্মকর্তারা।
এই পর্যায়ে গ্রাহকদের টাকা উদ্ধারে গঠন করা হয় ‘যশোর এহসান ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংগ্রাম কমিটি’। কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমন আরো বলেন, ‘যশোর অঞ্চল থেকে ৩২২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মূলত জড়িত এহসান গ্রুপের এহসান এস বাংলাদেশ ও রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের মুফতি আবু তাহের নদভী, এহসান এস যশোর শাখার ব্যবস্থাপক আতাউল্লাহ, প্রধান নির্বাহী অর্থ মহাব্যবস্থাপক মুফতি জুনায়েদ আলী ও ক্যাশিয়ার আইয়ুব আলী। তাদের বিরুদ্ধে আগেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হয়। মামলাও দায়ের করা হয়, যা তদন্ত করে পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআই। তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও মেলে। ৫৬ জন বিনিয়োগকারী টাকার শোকে মারা গেছেন এমন জনশ্রুতিও আছে। এত কিছুর পরও রাগীব এত দিন ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিলেন।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জনে রাগীব তার প্রতিষ্ঠানের নামে ওয়াজের আয়োজন করতেন। বিদেশ থেকে ধর্মীয় বক্তাদের এনে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বক্তব্য দেওয়াতেন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এভাবে টাকা নিয়ে তিনি আবাসন ব্যবসা ও জমি কেনায় বিনিয়োগ করেছেন। রাগীব এ ধরনের সাত-আটটি প্রকল্প থাকার কথা স্বীকারও করেছেন। তবে হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা নিয়ে তিনি নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়েছেন।’
পিরোজপুর সদর থানার ওসি মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, রাগীব ও তার তিন ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে অভিযোগের ব্যাপারে জানা যাবে। তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। আবার ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়েও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, রাগীবের ভাই মাহমুদুল পিরোজপুর বাজার মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাগীবের বাবা মাওলানা আব্দুর রব, শ্বশুর শাহ আলমসহ তাদের পরিবার জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দণ্ডিত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সঙ্গে এই পরিবারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এলাকায় জামায়াত ও ধর্মীয় নেতা বলে তার একটি অনুসারী দল তৈরি হয়েছে। তাদের অনেকেই এহসান গ্রুপের কর্মী। কিছু জামায়াত কর্মীও এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয়। তারা রাগীবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তারা এখনো সক্রিয় থেকে গ্রাহকদের ঠেলে দিচ্ছেন সাধারণ কর্মীদের দিকে।
পিরোজপুরের মাঠকর্মী মাওলানা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকে আলেমদের দেখে না বুঝে বিনিয়োগ করেছেন। আমরা কাজ করেছি। অনেকে তাদের ঘনিষ্ঠ। তাদের এখন পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কর্মীরা আমাদের এসে ধরছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের জনগণকে যদি শতভাহ শিক্ষিত যেতো, তবে এমন প্রতারণনা কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। আক্ষরিক জ্ঞান না থাকা বেশিরভাগ মানুষ শোনা কথায় বিশ্বাসী হয়ে ফাঁদে পা দেন। এ থেকে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম দেশকে শতভাগ শিক্ষিত তৈরী করা এবং প্রতারকদের শাস্তি নিশ্চিত করা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯০৪
আপনার মতামত জানানঃ