গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মূল কারণ। গ্রিন হাউস গ্যাসের ৭২% কার্বন ডাই অক্সাইড, যা উষ্ণায়নের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। কল-কারখানা, যানবাহনে তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল ও ইথানল পুড়ানোর কারণে বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাসের পরিমাণ বাড়াছে। পাশাপাশি জলীয় বাষ্প, মিথেন ও সিএফসি গ্যাসও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকৃতিতে দূষণ ঘটাচ্ছে বলেও মনে করেন বিজ্ঞানিরা।
গ্রিন হাউজ গ্যাসকের মূল কাজই হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুকে জীবন উপযোগী তাপমাত্রার মধ্যে রাখা। তবে দিন দিন এ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে সূর্যে তাপ বিকিরণ বাধা পাচ্ছে বলে মনে বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে এ কারণে বাড়ছে পৃথিবীর উষ্ণতা; ঘটছে জলবায়ুর বিপর্যয়।
সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গবাদি পশু বাড়লে কার্বন নিঃসরণও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। বিশ্বের মোট গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের ১৪.৫ শতাংশের জন্যই প্রাণী পালন ও প্রাণী প্রজনন দায়ী। খবর দ্য গার্ডিয়ান
সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশটি গবাদিপশুর কোম্পানি যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে জার্মানির, ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্সও সে পরিমাণ গ্যাস নিঃসরণ করে না। এসব প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন পাচ্ছে।
২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাংস দুগ্ধজাত খাবার উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ৪৭৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ২ হাজার ৫০০ বিনিয়োগ ফার্ম, ব্যাংক ও পেনশন তহবিল থেকে অর্থায়ন পেয়েছে। অর্থায়নকারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপভিত্তিক।
সবচেয়ে বেশি মাংস উৎপাদন করে চীন, ব্রাজিল, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। ২০২৯ সালে এই দেশগুলো গোটা বিশ্বের ৬০ শতাংশ মাংস উৎপাদন করবে।
বিশ্বের মোট কৃষিজমির ৭৫ শতাংশই ব্যবহৃত হয় গবাদি পশু পালনে কিংবা তাদের খাবার উৎপাদনে। শুধু ব্রাজিলেই ১৭৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে গবাদিপশু পালন করা হয়। যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট কৃষি এলাকার সমান।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আট লক্ষ বছরের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্বের পরিমাণ সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয়েছে।
নোয়ার প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৪১২.৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় এই মাত্রা ২.৫ পিপিএম পর্যন্ত বেশি।
বিজ্ঞানীদের মতে, রেকর্ড তথ্য ও পর্যবেক্ষণ অনুসারে এখন পর্যন্ত বাতাসে এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের সর্বোচ্চ মাত্রা।
গবেষণার জন্য আধুনিক ইনস্ট্রুমেন্টাল পদ্ধতি অনুসরণ করে ডেটা সংগ্রহ করা হয়। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণে আনা হয় আট লাখ বছর আগের আইস কোর রেকর্ড।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৩৯ বছরের মধ্যে ২০২০ সালে মহাসাগরে জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ। এছাড়া, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড় কার্বন মাত্রার চেয়ে তা ৩০ শতাংশ বেশি।
গত বছর জলবায়ু নির্দেশক বেশ কিছু সূচকে রেকর্ড মাত্রা দেখা যায়। টানা নয় বছর থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে নতুন রেকর্ডে গিয়ে পৌঁছে। হিমবাহ ও বরফের স্তর গলে যাওয়ায় প্রতি দশকে বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক ইঞ্চিরও কিছু বেশি বেড়ে চলেছে। একইসঙ্গে উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র।
এছাড়া, দু’শ বছরের মধ্যে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তিনটি তাপমাত্রার মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালে রেকর্ডকৃত ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা।
জলবায়ু এবং বায়ুমণ্ডলে পরিবর্তন আসায় তীব্র খরা, দাবানল, গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়, বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত থেকে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে।
প্রাথমিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে মানব নিঃসৃত গ্রিন হাউজ গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে হলে মাংস শিল্পকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু সংকটকে মোকাবিলা করতে হলে ধনী দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণে মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া কমাতে হবে। বড় আকারের মাংস ও প্রাণীজ প্রোটিন উৎপাদন প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৫
আপনার মতামত জানানঃ