আফগানিস্তানে এখনো রাস্তায় গাড়ি চলছে, বাজারে আঙুর বিক্রি হচ্ছে, রাস্তায় শিশুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। উপর উপর পুরো শহর ঠিক আছে বলে মনে হলেও, আসলে কিন্তু তা নয়। তালিবানের ভয়ে পুরুষরা দাড়ি শেভ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এর বদলে তারা দাড়ি লম্বা রাখছে। নারীরা রঙ-বেরঙের স্কার্ফের বদলে কালো রঙের বোরকা ব্যবহার করছে। এছাড়া নিজেদের পোশাক এবং চাদরের দৈর্ঘ্য পরীক্ষা করে পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে বাইরে বের হচ্ছে।
সে দেশে ব্যাপক আতঙ্কে দিন কাটছে নারী বিচারকদের। নারী বিচারকদের আতঙ্কের অন্যতম কারণ হলো— যেসব অপরাধীকে তারা কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, তালিবান বাহিনী কাবুল দখল করার পর প্রায় সব কারাবন্দিকে মুক্ত করে দেওয়ায় তারাও মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন প্রতিশোধের নেশায় ঘুরছেন তারা। কারামুক্ত অপরাধীদের কারণেই আফগান বিচারকদের জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যানুসারে, আফগানিস্তানে নারী বিচারক রয়েছেন ২৫০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজন দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। বাকিদের বেশিরভাগ আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন।
২০ বছর আগে আফগানিস্তান যখন তালিবানের দখলে ছিল, মেয়েদের যাবতীয় অধিকার খর্ব করেছিল সংগঠনটি। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। বাইরে কাজ করার অনুমতি ছিল না। পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বাড়ির বাইরে এক পা ফেলা বারণ ছিল তাদের। ছিল আরও বহু বহু নিষেধাজ্ঞা। ফলে তালিবান ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আতঙ্কে নারীরা।
তালিবান অবশ্য বলছে, তারা আর আগের মতো নেই। মেয়েদের অধিকার দেওয়া হবে, তবে শরিয়ত মেনে। ফলে আদৌ ঠিক কতটা ছাড় মিলবে, তা নিয়ে সন্দিহান মেয়েরা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্র, পুরুষ ও মেয়েদের একসঙ্গে কাজ করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তালিবান।
নারী বিচারকরা বলছেন, তারা প্রবল আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। গত জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের দুই নারী বিচারপতিকে গুলি করে খুন করেছিল তালিবান।
আফগানিস্তানের এক শীর্ষস্থানীয় নারী বিচারক ইতিমধ্যেই ইউরোপে পালিয়ে গেছেন। একটি গোপন স্থান থেকে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, ‘তালিবান আফগানিস্তানের সব বন্দিকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। নারী বিচারকেরা সত্যি প্রাণসংশয়ে রয়েছেন।
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চার-পাঁচ জন তালিবান জঙ্গি বাড়ি গিয়ে আমার খোঁজ করছিল। জানতে চাইছিল, আমি কোথায়? এই লোকগুলোকেই আমি কারাদণ্ড দিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, নারী আইনজীবীরা ভীষণ ভয়ের মধ্যে আছেন। আফগানিস্তান থেকে তাদের উদ্ধার করা না-হলে তালিবানরা মেরে ফেলব।
তিনি আরও জানান, শুধু নারী বিচারকরা নন, নারী আইনজীবী ও নারী পুলিশ সবাই প্রাণভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। জেল থেকে বেরোনো বন্দিরা সরাসরি হুমকি দিচ্ছে।
ব্রিটিশ বিচারমন্ত্রী রবার্ট বাকল্যান্ড বলেন, গত সপ্তাহে লন্ডন নয় নারী বিচারককে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা আরও মানুষকে নিরাপদের বের করে আনার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছে।
‘এই বিচারকদের অনেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিলেন এবং তালিবানের উত্থানে কি পরিণতির মুখোমুখি তাদের হতে হবে, তা নিয়ে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে’।
মানবাধিকার ও আইনকর্মীরা বলছেন, কাবুল পতনের পর বিশৃঙ্খলার মধ্যে নারী বিচারক ও অধিকারকর্মীদের বের করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে পশ্চিমা দেশগুলো প্রাধান্য দেয়নি।
বেলফাস্টভিত্তিক মানবাধিকার আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবীদের সমিতি অ্যাটলাস উইমেন রেটওয়ার্কের সদস্য সারা কে বলেন, নিজেদের নাগরিক ছাড়া বাকিদের বের করে নেওয়ার বিষয়ে সরকারগুলোর তেমন আগ্রহ নেই।
সারা কে কাজ করছেন ‘ডিজিটাল ডানকির্ক’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী অনলাইন গ্রুপের সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের দখলে থাকা ফ্রান্স থেকে ব্রিটিশ বাহিনীকে উদ্ধারের ঘটনার স্মরণে এই গ্রুপের নামকরণ হয়েছে।
নিজেদের চ্যাট গ্রুপ অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে শত শত মানুষকে তারা আফগানিস্তান থেকে বের হতে সহায়তা করেছে।
আর নারী বিচারকদের আন্তর্জাতিক সমিতিতে ছয় বিদেশি বিচারকের একটি দল তথ্য সমন্বয়, সরকারগুলোর সঙ্গে দেনদরবার এবং উদ্ধার ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন।
তাদেরই একজন হলেন মার্কিন বিচারক প্যাট্রিশিয়া ওয়ালেন, যিনি ১০ বছরের একটি কর্মসূচির আওতায় আফগান নারী বিচারকদের প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছেন।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, আমাদের কাঁধে এখন যে বোঝা তা প্রায় অসহনীয়। কারণ মাত্র কয়েকজন এই দায়িত্ব নিচ্ছি। আমি খুবই ক্ষুব্ধ, আমাদের কারও এমন পরিস্থিতিতে পড়ার কথা ছিল না।
নারী অধিকার নিয়ে নাক না গলাতে বললেন তালিবান
আফগান নারীদের অধিকার নিয়ে নাক না গলানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তালেবান।
৩ সেপ্টেম্বর মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ আহ্বান জানান তালিবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন।
আফগানিস্তান তালিবানের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর দেশটির নারীদের প্রতি তালিবানের আচরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। পশ্চিমাদের এ উদ্বেগের জবাব দেন সুহাইল।
সাক্ষাৎকারে সুহাইল বলেন, আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। নারীদের শিক্ষা বা তাদের কাজ করার অধিকার নিয়েও কোনো সমস্যা নেই।
পশ্চিমাদের উদ্দেশে তালিবানের মুখপাত্র বলেন, ‘একে অন্যের সংস্কৃতি পরিবর্তন করার চেষ্টা না করলেই হলো। আমরা যেমন আপনাদের সংস্কৃতি পরিবর্তন করার কথা বলছি না, তেমনি আপনারাও আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করবেন না।’
মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের সব মানবাধিকার সংগঠন ও নারী রাষ্ট্র-সরকারপ্রধান আফগান নারীদের অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য জোটবদ্ধ হচ্ছেন।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ইতিমধ্যে বলেছেন, আফগানিস্তানে নারীদের অনেক কাজে তারা দেখতে চান। শিক্ষকতা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সমাজের অন্যান্য পেশায় আফগান নারীদের কাজ করার অধিকার দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে তারা নিশ্চিত নন।
সুহাইল তার সাক্ষাৎকারে বলেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে তাদের ভাবনায় পার্থক্য রয়েছে। তার ভাষ্যমতে অনুযায়ী, ‘পশ্চিমা মতে নারীদের হিজাব না পরেই শিক্ষা গ্রহণ করার কথা বলা হয়। আমাদের সংস্কৃতি বলে হিজাব পরে শিক্ষা গ্রহণের জন্য, হিজাব পরে চাকরি করার জন্য।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ