চিত্রনায়িকা শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনির জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল অকার্যকর বলে আদেশ দেয়ার পাশাপাশি পরীমনিকে রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টিকে ‘সভ্য সমাজে এভাবে চলতে পারে না’ বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
প্রসঙ্গত, চিত্রনায়িকা পরীমনি ২৮ দিন কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। জামিনের কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছানোর পর আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ছাড়া পান তিনি।
এর আগে পরীমনির মামলার ক্ষেত্রে রিমান্ডের অপব্যবহার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, পরীমনির মামলায় তৃতীয় দফা রিমান্ডের প্রয়োজন ছিল না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবেদন করলেন আর বিচারক (ম্যাজিস্ট্রেট) রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, এটা তো সভ্য সমাজে হতে পারে না।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ মন্তব্য করেন এবং জামিন প্রশ্নে রুলের ওপর আদেশ দেন।
শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট দু’জনের সামনে কী ম্যাটেরিয়াল ছিল এটা জানতে চাইব। কোনো ম্যাটেরিাল ছাড়া আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) প্রেয়ার দিল রিমান্ডের, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো তো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না, ঘটতে পারে না বর্তমানে। রিমান্ড অতি ব্যতিক্রমী বিষয়।’
পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা প্রশ্নে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) করা এক আবেদনের ওপর শুনানিকালে আদালত এসব মন্তব্য করেন।
আসকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, মো. মুজিবুর রহমান, ড. সৈয়দা নাসরিন ও অ্যাডভোকেট মো. শাহীনুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান।
অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না আদালতকে বলেন, রিমান্ড প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের যেসব নির্দেশনা নিম্ন আদালতকে মেনে চলতে বলা হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের মামলা ব্যতীত সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশনা মেনে চলা হয় না।
এ সময় আদালত বলেন, আবেদনকারীর তো জামিন হয়ে গেছে। তাই রুলটি শুনানির জন্য অকার্যকর (ইমফ্রাকচুয়াস) হয়ে গেছে। আর রিমান্ড নিয়ে যা বলছে, সে বিষয়ে তো আপিল বিভাগের গাইডলাইন আছেই। কিন্তু কেউ মানছে না।
অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন. রিমান্ড প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন যাতে অনুসরণ করা হয়, সেজন্য একটি আদেশ চাচ্ছি আমরা।
এরপর পরীমনিকে তিন দফায় কত দিন করে রিমান্ড নেওয়া হয়, সে বিষয়ে আদালতকে জানান অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় যে বিধান আছে এবং আমাদের আপিল বিভাগের যে গাইডলাইন আছে এগুলো পরীমনির রিমান্ডের ক্ষেত্রে ফলো না করেই তাকে তিন দফায় ৭ দিন রিমান্ডে নিয়েছে।
আসকের নির্বাহী সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আছে। সে নির্দেশনা অনুসরণ না করে পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। রিমান্ডের ক্ষেত্রে যাতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিম্ন আদালত অনুসরণ করেন, এটিই প্রার্থনা।
সূত্র মতে, কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষেত্রে নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়েছে, অন্য নাগরিকদের বেলায় তা অনুসরণ করা হয়নি।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৫ এবং ৪৩৯ ধারা অনুযায়ী জামিনের রুল বিচারাধীন থাকাবস্থায় রিমান্ডের প্রশ্নটি পরীক্ষা করতে পারি। নথি তলব করতে পারি। প্রয়োজন হলে বিচারককে তলব করতে পারি। হাইকোর্ট বিভাগ সবকিছু করতে পারে।
আদালত বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা কী তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রিমান্ডের আবেদন করল, আর বিচারিক আদালত তা মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো পরীক্ষা করা দরকার।
আদালত বলেন, এগুলো তো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না, ঘটতে পারে না। আদালত আরও বলেন, ৪৩৯ ধারার আলোকে মহানগর দায়রা জজ আদালত জামিন আবেদন (৪৯৮ ধারায়) কত দিনের মধ্যে শুনবেন সে বিষয়ে আমরা একটি গাইডলাইন দেব।
এর আগে গত ৪ আগস্ট পরীমনিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর র্যাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বনানী থানায় মামলা করে। এ মামলায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত বৃহস্পতিবার পরীমনির এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। বনানী থানায় করা এই মামলায় পরীমনিকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেছিল সিআইডি। শুনানি শেষে আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর আগে একই মামলায় প্রথম দফায় চারদিন ও দ্বিতীয় দফায় দুদিন রিমান্ডে নেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
১৯ আগস্ট পরীমনির জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। এর বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন পরীমনি। এই আদালত ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন রাখেন। পরদিন আবেদন ‘আর্লি হিয়ারিং’ বা নির্ধারিত সময়ের আগে শুনানি চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবী। এতে ফল না পেয়ে ২২ আগস্টের ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে ২৫ আগস্ট হাইকোর্টে আবেদন করেন পরীমনির আইনজীবী।
শুনানি নিয়ে ২৬ আগস্ট হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে জামিন আবেদন শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। জামিন আবেদনের শুনানি দ্রুত (আর্লি হিয়ারিং) তথা দুদিনের মধ্যে করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে ১ সেপ্টেম্বর রুল শুনানির তারিখ রাখা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় আজ বিষয়টি শুনানির জন্য ওঠে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় পরীমনিকে তিন দফায় সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বতঃপ্রণোদিত রুল চেয়ে ২৯ আগস্ট একই বেঞ্চে একটি আবেদন দাখিল করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আজকের শুনানিতে পরীমনির রিমান্ডের বিষয়টি ওঠে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ করেই ঢাকাই সিনেমার নায়িকা পরীমনিকে আটক করা হয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব অভিযান চালায় তার বাড়িতে। অভিযানের আয়োজন দেখে মনে হয়েছিল বিশাল মাদক ব্যবসায়ী, কালোবাজারী, খুনি কাউকে ধরা হচ্ছে। এরপর মিডিয়া ট্রায়ালে পরীমনির গ্রেফতারের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয় রাজ, পিয়াসা, মৌ এবং হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তারের ঘটনা।
মামলা হবার আগেই গ্রেফতার দেখানো হয় পরীমনিকে; মাদক মামলা। প্রচুর মদের বোতল পাওয়া গেছে বলে জানায় র্যাব। স্থানীয় গণমাধ্যম অনুযায়ী শুরু থেকেই মদ ছাড়াও অন্যান্য মাদক পাওয়া গেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্ট করে এই অভিযোগ জানায়নি পুলিশ কিংবা র্যাব। এরপর পরীমনিকে আরও নানা অভিযোগে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। যদিও সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাব ছিল সব অভিযোগেই। এ অবস্থাতেও টানা তিনবার রিমান্ডে নেয়া এবং ২৮ দিনের কারাবাসের কারণ মূলত রহস্যই।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ