ভারত থেকে শুরু হওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের কারণে অনেক দেশে এখনো সংক্রমণ-মৃত্যু তুঙ্গে। মহামারি করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ধরনের তাণ্ডবের পর আবারও গোটা বিশ্বকে মাতাতে আসছে করোনার দ্রুত রুপান্তরিত আরও দুই ধরন। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় করোনাভাইরাসের একটি নতুন পরিবর্তিত ধরন শনাক্ত হয়েছে। গ্রীক বর্ণমালার ক্রম অনুযায়ী এই ধরনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিউ’। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনার নতুন একটি ধরন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন।নতুন এ ধরনটি সি.ওয়ান.টু. নামে পরিচিত।
করোনার নতুন ধরন ‘মিউ’
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় করোনাভাইরাসের একটি নতুন পরিবর্তিত ধরন শনাক্ত হয়েছে। গ্রীক বর্ণমালার ক্রম অনুযায়ী এই ধরনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিউ’। বর্তমানে করোনার এই ধরনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পর্যবেক্ষণের তালিকায় (ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেনস্ট) রয়েছে বলে মঙ্গলবার সাপ্তাহিক প্যানডেমিক বুলিটিনে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। খবর এএফপি
চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রথম মিউয়ে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে উল্লেখ করে বুলেটিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, প্রাথমিক গবেষণায় আমাদের মনে হচ্ছে, টিকা নেওয়ার পর মানবদেহে যে সুরক্ষা তৈরী হয়, তাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম এই ধরনটি।
তবে এর সংক্রমণ ক্ষমতা ঠিক কতখানি এবং করোনার অন্যান্য ধরনসমূহের তুলনায় এটি কী পরিমাণ প্রাণঘাতী— তা জানার জন্য আরো বিস্তারিত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্যবার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের দেহে সংক্রমিত হতে হতে বেশ কয়েক দফা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে সার্স কোভ-২ ভাইরাস বা নভেল করেনাভাইরাস। ফলে, বিশ্বে আবির্ভাব ঘটেছে এর অনেকগুলো বিবর্তিত ধরনের। সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে পরিবর্তিত এই ধরনসমূহের মধ্যে প্রধান বা প্রতিনিধিত্বশীল ধরনগুলোর বৈজ্ঞানিক নামের পাশাপাশি গ্রিক বর্ণমালা অনুসারে সেগুলোর নামকরণ করেছে ডব্লিউএইচও।
এর আগে এ রকম ছয়টি ধরনকে করোনাভাইরাসের প্রধান ও প্রতিনিধিত্বশীল ধরন হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ। এগুলো হলো— আলফা, বিটা, গ্যামা, ডেল্টা, কাপ্পা ও ল্যাম্বডা। এবার এই তালিকায় সপ্তম হিসেবে যুক্ত হলো মিউ, যার বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.৬২১।
গত প্রায় দেড় বছরে বিবর্তনের ফলে মূল করোনাভাইরাসের যে পরিবর্তিত ধরনসমূহের আবির্ভাব ঘটেছে সেগুলোকে দু’টি তালিকায় ভাগ করেছে ডব্লিউএইচও— পর্যবেক্ষণ তালিকা (ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট) এবং উদ্বেগজনক তালিকা (ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন)।
বর্তমানে ডব্লিউএইচওর উদ্বেগজনক ধরনের তালিকায় রয়েছে আলফা ও ডেল্টাসহ ভাইরাসের চারটি পরিবর্তিত ধরন। বিশ্বের ১৯৩ টি দেশে আলফায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, আর ডেল্টায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে ১৭০ টি দেশে। অন্যদিকে, মিউসহ আরও ৫ টি পরিবর্তিত ধরনকে পর্যবেক্ষণ তালিকাভূক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সাপ্তাহিক বুলেটিনে সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে— কলম্বিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশ এবং ইউরোপে ইতোমধ্যে এই ধরনটিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া কলম্বিয়ায় বর্তমানে সক্রিয় করোনা রোগীদের ৩৯ শতাংশ মিউয়ে আক্রান্ত।
দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুত রূপান্তরিত করোনার নতুন ধরন
দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া গেছে দ্রুত রূপান্তরিত আরেকটি নতুন ধরন। এর নাম দেওয়া হয়েছে— সি.ওয়ান.টু। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ধরন খুব দ্রুত রূপান্তরিত হয়। সম্প্রতি কয়েক মাসে এর রূপান্তরের হার বেড়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজ স্থানীয় সময় গতকাল এ তথ্য জানিয়েছে। খবর এএফপির।
গত সপ্তাহে কাওয়াজুলু-নাতাল রিসার্চ ইনোভেশন অ্যান্ড সিকোয়েন্সিং প্ল্যাটফর্ম এক গবেষণায় নতুন এ ধরনের তথ্য জানান। নতুন ধরনটি নিয়ে আবার পর্যালোচনা চলবে বলে জানানো হয়।
বিজ্ঞানীরা ধরনটি নিয়ে এখনো পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে যেটুকু উদঘাটন করতে পেরেছেন, তা হলো— ধরনটির রূপান্তরের হার অন্য ধরনগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ। গত কয়েক মাসে এর রূপান্তরের হার আরও বাড়ছে। এ নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে বলে জানানো হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে আক্রমণ শানাচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এর মধ্যেই সি.ওয়ান.টু নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত ৯টি প্রদেশে নতুন এই ধরন পাওয়া গেছে। এছাড়া ধরনটি শনাক্ত হয়েছে চীন, নিউজিল্যান্ড, মৌরিতাস, এবং ব্রিটেনে। এ নিয়ে বিশদভাবে জানাতে আর কিছু সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজ-এর গবেষক পেনি মুর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, করোনার ভ্যাকসিন ধরনটির বিরুদ্ধে কীভাবে কাজ করবে কিংবা কতটা কাজ করবে, সেটা নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। তবে টিকা যে আমাদেরকে এ সংক্রান্ত গুরুতর অসুস্থতা থেকে রক্ষা করবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে ডেল্টা ও বেটা ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে, এই ধরন ততটা উদ্বেগজনক না–ও হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এ পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ২৭ লাখ মানুষ। মৃত্যু হয়েছে ৮১ হাজার ৮৩০ জনের।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে সাপের বিষ
করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আশার আলো দেখাচ্ছেন ব্রাজিলের গবেষকেরা। তারা বলছেন, দেশটিতে পাওয়া যায় এমন একটি প্রজাতির সাপের বিষে থাকা উপাদান করোনা রোধে বেশ কার্যকর বলে দেখা গেছে। প্রাথমিকভাবে বানরের কোষের ওপর এ নিয়ে পরীক্ষা চালানো হলেও গবেষকেরা ধারণা করছেন, সফলতার দিকে এটি প্রথম ধাপ।
করোনাভাইরাসের পুনরুৎপাদনে মূল ভূমিকা রাখে ভাইরাসটির ‘পিএলপ্রো’ নামের একটি এনজাইম। সাপের বিষের উপাদানে থাকা ‘অ্যামিনো অ্যাসিডের চেইন’ ওই এনজাইমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। ফলে করোনার পুনরুৎপাদনক্ষমতা কমে আসে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, চলতি মাসেই ‘মলিকিউলস’ নামের একটি বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকীতে ওই গবেষণার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বানরের শরীরের কোষে জারারাকুসু নামের সাপের বিষে পাওয়া উপাদান করোনাভাইরাসের পুনরুৎপাদনক্ষমতা ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।
জারারাকুসু ব্রাজিলের দীর্ঘাকৃতির সাপগুলোর মধ্যে একটি। ব্রাজিল ছাড়াও বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনায় সাপগুলোর দেখা মেলে। মারাত্মক বিষধর এ সাপ ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
জারারাকুসু সাপের বিষ কীভাবে করোনার বিরুদ্ধে কাজ করে, তা জানিয়েছেন ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক রাফায়েল গুইদো। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের পুনরুৎপাদনে মূল ভূমিকা রাখে ভাইরাসটির ‘পিএলপ্রো’ নামের একটি এনজাইম। সাপের বিষের উপাদানে থাকা ‘অ্যামিনো অ্যাসিডের চেইন’ ওই এনজাইমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। ফলে করোনার পুনরুৎপাদনক্ষমতা কমে আসে।
বিষে থাকা এই ‘অ্যামিনো অ্যাসিডের চেইন’ বা পেপটাইড গবেষণাগারে উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন গবেষক রাফায়েল গুইদো। তাই বিষের জন্য জারারাকুসু নামের সাপ শিকার বা এর খামার গড়ে তোলার কোনো প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
তবে এরপরও সাপটি শিকার করা নিয়ে শঙ্কিত ব্রাজিলের জীববিদ্যাবিষয়ক গবেষণাকেন্দ্র বুতানতান ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা গিউসেপে পুয়োর্তো। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি, ব্রাজিলজুড়ে মানুষ জারারাকুসু শিকারে বের হবে। তাদের মনে হবে, তারা বিশ্বকে রক্ষা করতে যাচ্ছে। তবে বিষয়টি এমন নয়। শুধু সাপের বিষই করোনা সারিয়ে তুলতে পারে না।’
এদিকে বানরের শরীরে আরও পরীক্ষা চালানোর পর বিষের উপাদানটি মানুষের কোষের ওপর প্রয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। তবে তা কবে থেকে শুরু হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি।
বিশ্বে বেড়েছে সংক্রমণ-প্রাণহানি
চলমান করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। একইসঙ্গে আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে নতুন রোগীর সংখ্যাও। গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ৯ হাজার মানুষ। একই সময়ে নতুন করে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬ লাখ ৭ হাজার।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। তবে দৈনিক মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল। এতে বিশ্বব্যাপী করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২১ কোটি ৮৫ লাখের ঘর। অন্যদিকে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৩২ হাজার।
বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) সকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, মৃত্যু ও সুস্থতার হিসাব রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮ হাজার ৯২৪ জন। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ১৬০০-র বেশি। এতে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৫ লাখ ৩২ হাজার ৫০৮ জনে।
এছাড়া, একই সময়ের মধ্যে ভাইরাসটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৭ হাজার ১৮৮ জন। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় এক লাখ। এতে মহামারির শুরু থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ৮৫ লাখ ১১ হাজার ৬১৫ জনে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর গত বছরের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর আগে একই বছরের ২০ জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে সংস্থাটি।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ