টিকা মানুষের জীবন সুরক্ষার হাতিয়ার। সেখানে টিকাই মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। করোনা মহামারি প্রতিরোধের অন্যতম মাধ্যম যেমন টিকা, তেমনি আরেকটি হলো সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। টিকা নিতে গিয়ে সামাজিক দূরত্বের তো কোনো বালাই নেই, উল্টো ভিড়ে পদদলিত হয়ে আহত হচ্ছে মানুষ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে এক দিনে প্রায় ১১ লাখ মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দিয়েছে রাজ্য সরকার। তবে এই বিপুল পরিমাণ মানুষকে টিকা দিতে গিয়ে জলপাইগুড়ি জেলার একটি টিকা কেন্দ্রে পদদলিত হয়ে আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন।
জলপাইগুড়ি পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্ট দেবশ্রি দত্ত বলেন, প্রায় ২০ জন আহত হয়। কিন্তু ১৫ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর পাঁচ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। আর আট জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি ব্লকের একটি স্কুলকে বানানো হয় টিকাদান কেন্দ্র। ওই স্কুলের প্রবেশ পথে ভোর থেকে জড়ো হয় শত শত মানুষ। সমবেতরা মূলত আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দা আর চা বাগানের শ্রমিক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, টিকা কেন্দ্রের কাছে প্রায় ২ হাজার মানুষ জড়ো হয়। আর সেখানে ভোরে পুলিশের কোনো উপস্থিতিও ছিলো না।
সকাল দশটার দিকে পুলিশ উপস্থিত হয়ে স্কুলের গেট খুলে দিলে সমবেতরা দ্রুত একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে যায়। হুড়োহুড়িতে বেশ কয়েক জন নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি মাঠে পড়ে যায়। মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে আহত হয় এক পুলিশ সদস্যও। পরে বেশি সংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে স্থানীয়রাও। সরকার থেকে ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় টিকা নিয়ে ঘটেছিলো অন্যরকম অরাজকতা। হদিস মিলেছিলো করোনার এক ভুয়া টিকাকেন্দ্রের। কেন্দ্রটি থেকে শত শত মানুষকে ভুয়া টিকা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এটির কর্ণধারকে। তিনি নিজেকে কলকাতা পৌর করপোরেশনের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্থানে টিকাদান শিবির চালিয়ে যান। নিজেকে একজন আইএএস কর্মকর্তা হিসেবেও পরিচয় দেন তিনি।
ঐ টিকাকেন্দ্রে টিকা নেন তৃণমূল সাংসদ ও অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীও। কিন্তু টিকা দেওয়ার পর তাকে কোনো সনদ দেওয়া হয়নি। তাকে বলা হয়, মুঠোফোনে পাঠানো হবে সনদ। পরে মুঠোফোনেও সনদ না এলে মিমির সন্দেহ হয়। এরপরই তিনি শরণাপন্ন হন কসবা থানার। পুলিশ তদন্তে নেমে কসবার রাজডাঙ্গায় অবস্থিত কেন্দ্রটি ভুয়া হিসেবে জানতে পারে। এরপর এই কেন্দ্রের কর্ণধার ২৮ বছরের যুবক দেবাঞ্জন দেবকে গ্রেপ্তার করে। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সরকারি স্টিকার লাগিয়ে গাড়িতে চড়তেন তিনি। ছিল সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীও।
দেবাঞ্জনের চালচলনে এতটুকু ঘাটতি ধরা পড়েনি। তিনি কসবার টিকাকেন্দ্রে গত ১০ দিনে বিনা মূল্যে টিকা প্রদান করেন প্রায় দেড় হাজার মানুষকে। টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা আদায় করেন তিনি। চাঁদা হিসেবে নেন লাখ লাখ রুপি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শুধু কসবায় নয়, কলকাতার সিটি কলেজেও টিকাদান ক্যাম্প খুলে কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদেরও ভুয়া টিকা প্রদান করেছেন তিনি।
পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, দেবাঞ্জন দেব বিভিন্ন ক্যাম্পে কোভিশিল্ড, কোভ্যাকসিন ও স্পুতনিক-৫ টিকা দিয়ে আসছিলেন। পৌর করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান কাউন্সিলর অতীন ঘোষ জানান, দেবাঞ্জন যে টিকা দিয়েছেন, তা আদৌ কোভিশিল্ড, কোভ্যাকসিন বা স্পুতনিক নয়। আসল কোভিশিল্ডের মতো দেখতে হলেও ভায়ালে উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ বা উৎপাদনকারী কোম্পানির নাম নেই। শুধু কোভিশিল্ড লেখা। ফলে এই ভায়াল যে জাল, তা মনে করছে পৌর করপোরেশন। পুলিশ এখন খোঁজ করছে এই দেবাঞ্জনের সঙ্গে আর কারা জড়িত। কারণ, দেবাঞ্জন একটি বিরাট দল নিয়ে এই প্রতারণা চালাচ্ছিলেন। তার রয়েছে বেশ কয়েকজন কর্মচারী, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী এবং প্রচুর অর্থ দিয়ে তাদের রাখা হয়েছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে দেবাঞ্জন বলেছেন, তিনি এই টিকা কিনেছেন কলকাতা বড়বাজারের ওষুধের পাইকারি বাজার বাগরি মার্কেট থেকে। পরে পুলিশ দেবাঞ্জনের কসবার দপ্তরে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ভুয়া টিকা উদ্ধার করেছে।
কলকাতা পৌরসভা মনে করছে, দেবাঞ্জন করোনা টিকার নামে হাম বা বিসিজি টিকাও দিতে পারেন। উদ্ধার হওয়া ওই টিকা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠানো হচ্ছে। তবে জাল কোভিশিল্ডের ভায়ালে কোভিশিল্ডসহ মিক্সড ভ্যাকসিন লেখা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকা নিয়ে সতর্কতা এখন সময়ের দাবি। যেহেতু মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে তাই টিকাকেন্দ্রগুলোতে ভিড় এখন স্বাভাবিক ঘটনা। তবে নিতে গিয়ে আহত হওয়া কিংবা তুমুল ভোগান্তির শিকার হওয়া রোধ করতে প্রসাশনের সতর্কতা বেশি জরুরি।
অন্যদিকে কিছু সু্বিধাবাদিদের কাছে এই করোনা মহামারি পৌষ মাস। টিকা নিয়ে ব্যবসা করে নিজেদের পকেট ভর্তি আর সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে যেনো সফল না হয় দুর্বৃত্তরা এদিকেও প্রসাশনের কড়া নজরদারি দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এসডব্লিউ/এমএন/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ