তালিবানের দখলে যাবার পর থেকে আফগানিস্তানকে যে অবক্ষয়গুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো গণমাধ্যম। আজ বৃহস্পতিবার ২৬ আগস্ট টোলো নিউজের সাংবাদিক জিয়ার ইয়াদ খানকে গুলি করে হত্যা করে তালিবান। আফগানিস্তানের দখল নিতে শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ জন সাংবাদিক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে তালিবানের দ্বারা। এমনকি গণমাধ্যমের প্রধানকেও গুলি করে হত্যা করে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
গতবার তালিবান ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গণমাধ্যম বলতে কিছুই ছিলো না। কেউ টেলিভিশন দেখলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো এবং টিভিটি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হতো। ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটির গণমাধ্যম খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। সে সময় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। তবে আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতার মধ্যে গত তিন মাসে মোট ৫১টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। টলো নিউজের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ইয়াহু নিউজ।
জিয়ার ইয়াদ খানের মৃত্যুর খবর কতটা সত্য!
জিয়ার ইয়াদ খান টুইটারে লেখেন, ‘কাবুলের নতুন শহরে রিপোর্টিংয়ের সময় আমাকে তালিবান পিটিয়েছে। ক্যামেরা, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং আমার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছু মানুষ আমার মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে, যা মিথ্যা। তালিবান যোদ্ধারা একটি সামরিক ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আর আমাকে বন্দুকের মুখে মারপিট করে।’
এর আগে গত জুলাইতে পুলিৎজার জয়ী ভারতীয় সাংবাদিক দানিস সিদ্দিকিকে কান্দাহারে হত্যা করে তালিবান। তিনি একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার হয়ে কাজ করছিলেন।
যদিও গত ১৫ আগস্ট তালিবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেন, তারা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। আর সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত আফগানিস্তানের প্রথম স্বাধীন নিউজ চ্যানেল টোলো নিউজের এক সাংবাদিককে হত্যার খবর দিয়েছে সম্প্রচারমাধ্যমটি। রাজধানী কাবুলে পেশাগত কাজের সময় বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) জিয়ার ইয়াদ খানকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানানো হয় খবরে। এসময় তার ক্যামেরাম্যানকেও মারধর করে তালিবান।
টোলো নিউজ জানিয়েছে, কাবুলের হাজি ইয়াকুব ইন্টারসেকশনে দারিদ্র, বেকারত্ব নিয়ে প্রতিবেদন করার সময় রিপোর্টার জিয়ার ইয়াদ খান ও তার ক্যামেরাম্যানের উপর হামলা করে তালিবান।
আফগানিস্তানে চলতি বছরে ৩০ গণমাধ্যম কর্মী হতাহত
আফগানিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ভাগে কমপক্ষে ৩০ গণমাধ্যম কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে হতাহত হয়েছেন। এদের বেশিরভাগকে সরকারি কর্মকর্তারাও হুমকি দিয়েছেন বলে আফগানিস্তানের একটি অলাভজনক সংস্থা নাইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি কাবুলে বোমা বিস্ফোরণে দুই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন নারী সাংবাদিক। এমনকি স্থানীয় সাংবাদিকরা অভিযোগ করেছেন, আফগানের বালখ প্রদেশে সরকারি কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় তথ্য দেয় না।
নাইয়ের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে খামা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, কিলিদ গোষ্ঠীর এক সাংবাদিককে কাবুল শহরের একটি ঘটনা কভার করতে বাধা দিয়েছিল পুলিশ। তাকে কাবুল পুলিশ হুমকিও দিয়েছিল। অন্যদিকে, আফগান পিস পাবলিকেশন ওয়াচের এক সাংবাদিককে সরকারি কর্মকর্তারা অপমান করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও, আফগানিস্তানের বাওয়ার মিডিয়ার ২৬ জন কর্মচারীকে উত্তর বালখ প্রদেশে ছাঁটাই করা হয়েছে এবং চার কর্মচারীকে মিডিয়া আউটলেটগুলোকে তথ্য দেওয়ার জন্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ বরখাস্ত করেছেন।
ওই প্রতিবেদনে নাই গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় নিন্দা করেছে এবং এটিকে দেশের শ্রম আইনের ‘বিরুদ্ধে’ বলে অভিহিত করেছে।
গণমাধ্যম বিভাগের প্রধানকে গুলি করে হত্যা তালিবানের
আফগান সরকারের গণমাধ্যম বিভাগের প্রধানকে গুলি করে হত্যা করেছে তালিবানরা। রাজধানী কাবুলে একটি মসজিদের কাছে দাওয়া খান মিনাপলকে তারা গুলি করে।
এর আগে সরকারি কর্মকর্তাদের টার্গেট করে হত্যার হুমকি দিয়েছিল তালিবান। যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান বাহিনীর বিমান হামলার জেরে এ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল তারা। এর আগে তালিবানরা কাবুলে আফগান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতেও হামলা চালায়।
গণমাধ্যম বিভাগের প্রধান দাওয়া খান মিনাপলের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মিরওয়াইস স্টানেকজাই বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, বর্বর সন্ত্রাসীরা আবারও একটি কাপুরুষোচিত কাজ করেছে; একজন দেশপ্রেমিককে হত্যা করেছে।’
এ হত্যার দায় স্বীকার করে নেয় তালিবান। সশস্ত্র গোষ্ঠিটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মুজাহিদিনদের করা একটি বিশেষ হামলায় তিনি (দাওয়া খান মিনাপল) নিহত হয়েছেন।’
ডয়েচে ভেলের সাংবাদিককে না পেয়ে তার বাড়ির মানুষকে হত্যা
জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের একজন সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে না পেয়ে পরিবারের এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে তালিবান যোদ্ধারা। তাদের হামলায় আরও একজন আহত হয়েছেন বলে জার্মানির রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে সাংবাদিকদের খোঁজে বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছেন তালিবান যোদ্ধারা। তবে ওই সাংবাদিক এরই মধ্যে জার্মানিতে চলে গেছেন।
ডয়চে ভেলের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ওই সাংবাদিকের পরিবারের অন্য সদস্যরা শেষ মুহূর্তে পালিয়ে যেতে পেরেছেন এবং তারা এখন লুকিয়ে আছেন। সম্প্রচারমাধ্যমটির মহাপরিচালক পিটার লিমবুর্গ আফগানিস্তানে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের সহায়তায় পদক্ষেপ বাড়াতে জার্মান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
পিটার লিমবুর্গ বলেছেন, ‘আমাদের একজন সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে তালিবানের হত্যা অকল্পনীয় হৃদয়বিদারক ঘটনা। এ ঘটনা আফগানিস্তানে আমাদের সব কর্মী ও তাদের পরিবারের সমূহ বিপদের চিত্রকে স্পষ্ট করেছে। এটা প্রমাণিত যে কাবুল ও অন্যান্য প্রদেশে তালিবান পরিকল্পিতভাবে সাংবাদিকদের খুঁজছে।’
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার একদিন পর সংবাদ সম্মেলনে তালিবানের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কিছু করবে না। দেশে সংবাদমাধ্যমকে কাজ করতে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। এমনকি টেলিভিশন চ্যানেলে নারী উপস্থাপকের কাছে প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুযোগও দিয়েছিল কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠী। তবে এখন সাংবাদিকদের ওপর তাদের এই আক্রমণ ওই প্রতিশ্রুতির অসারতা প্রমাণ করছে।
৩০টি ভাষায় সংবাদ প্রকাশ করে ডয়চে ভেলে। সম্প্রচারমাধ্যমটি জানিয়েছে, তাদের অন্তত তিনজন সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়েছেন তালিবান যোদ্ধারা। অন্যান্য আফগান সাংবাদিককেও হত্যা করা হয়েছে। ৮ আগস্ট বেসরকারি সম্প্রচারমাধ্যম পাকতিয়া ঘাগ রেডিওর ব্যবস্থাপক তুফান ওমরকে গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, একই দিন দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের লস্কর গাহ–এ নিজের বাড়ি থেকে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদক নেমাতুল্লাহ হেমাতকে তুলে নিয়ে যান তালিবান যোদ্ধারা।
এ মাসেই আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় জালালাবাদ শহরে অনুবাদক আমদাদুল্লাহ হামদার্দকে গুলি করে হত্যা করে বন্দুকধারীরা। এরা তালিবান সদস্য বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। আমদাদুল্লাহ হামদার্দ একটি জার্মান পত্রিকার হয়ে কাজ করতেন। একজন আফগান নারী সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে গার্ডিয়ানকে লেখা একটি চিঠিতে তালিবানের রোষের মুখে নিজের ঘর ও প্রদেশ থেকে পালিয়ে থাকার বিবরণ দিয়েছেন।
তালিবানের সময় গণমাধ্যম যেমন ছিল
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান শাসনে গণমাধ্যম বলতে কিছু ছিল না। বাহিনীটি টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমকে ইসলামি মতাদর্শের বিরোধী বলে গণ্য করত। এমনকি সে সময় কিছু কিছু বৈদ্যুতিক পণ্যও অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
কেউ টেলিভিশন দেখলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো এবং টিভিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়া হতো। ভিডিও প্লেয়ারের মালিককে গণপিটুনি দেওয়া হতো। ক্যাসেট ধ্বংস করে এর ফিতা কাবুলের কিছু কিছু এলাকার গাছে ঝুলতে দেখা গেছে। তখন শুধু একটিই রেডিও স্টেশন ছিল। নাম ভয়েস অব শরিয়া। এটি শুধু প্রপাগান্ডা ও ইসলামিক অনুষ্ঠান প্রচার করত।
তালিবান উৎখাতে গণমাধ্যমে লাভ
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটির গণমাধ্যম খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। সে সময় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও নেটওয়ার্ক আসে। শুধু যে সংবাদের চ্যানেল তা নয়, চলচ্চিত্র, নাটক, প্রতিভা খুঁজে বের করার অনুষ্ঠান ও মিউজিক ভিডিও তৈরি হয় প্রচুর।
ন্যাশনাল প্রেস ফেডারেশনের কথা উল্লেখ করে চলতি মাসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানায়, আফগানিস্তানে এখন ৫০টি বেশি টেলিভিশন চ্যানেল, ১৬৫টি রেডিও স্টেশন ও কয়েক ডজন প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল গণমাধ্যমে মেয়েদের কাজ করার সুযোগ দান। যেখানে তালিবানের শাসনকালে নারীদের পরিবারের বাইরে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেখানে তালিবান পরবর্তী সময়ে শত শত নারী সাংবাদিকতা, প্রডিউসার, আয়োজক ও পারফর্মার হিসেবে পর্দার সামনে ও পেছনে কাজ করে গেছেন। এমনকি ডজন ডজন সাংবাদিক বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন।
৩ মাসে ৫১টি গণমাধ্যম বন্ধ ও হাজার গণমাধ্যমকর্মী চাকরিচ্যুত
আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতার মধ্যে গত তিন মাসে মোট ৫১টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। টলো নিউজের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ইয়াহু নিউজ।
আফগানিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চারটি টেলিভিশন নেটওয়ার্কসহ ১৬টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে।
আফগানিস্তানের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী কাসিম ওয়াফায়েজাদা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৩৫ টি গণমাধ্যম তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, ৬ টির বেশি সংবাদমাধ্যম তালিবানদের হাতে পড়েছে এবং তাদের কার্যক্রম প্রকাশের জন্য ব্যবহার হচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০০ রিপোর্টার এবং গণমাধ্যমকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে দেড় শতাধিক নারী রয়েছেন।
এতগুলো ঘটনা বিবেচনা করে তালিবানের কথা এবং প্রতিশ্রুতির সাথে তাদের কার্যক্রম মেলাতে পারছেন না বিশ্লেষকরা। তালিবানের প্রতিশ্রুতির সাথে কার্যক্রমের মিল থাকবে না এমন আশঙ্কা আগে থেকেই ছিলো। এবার এমন ঘটনা ঘটতে দেখে উদ্বিগ্নতা বেড়ে যাচ্ছে আফগান নাগরিকসহ সেখানে অবস্থান করা প্রত্যেকের।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ