জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চীনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ও বন্যা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশে ভয়ানক দাবানল ও তাপপ্রবাহের পর আরও এক রেকর্ড। সারা বছর বরফে ঢেকে থাকা গ্রিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ বরফচূড়ায় প্রথমবারের মতো বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে। ছিটেফোঁটা নয়, কয়েক ঘণ্টা ধরে বেশ ভালো মাত্রায় বৃষ্টি ঝরেছে সেখানকার বরফচাঁইয়ের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণায়নের ফলে মেরুঅঞ্চলের বরফ যে হারে গলছে, তাতে এই বৃষ্টিপাতকে নতুন উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
তাপমাত্রা যেখানে সাধারণত হিমাঙ্কের ওপর ওঠে না, সেখানেই মূষলধারে বৃষ্টি হলে তা নিঃসন্দেহে বিস্মিত হওয়ার মতো। আর এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে গ্রিনল্যান্ডের বরফচূড়ায়। শুধু তাই নয়, প্রথমবার সেখানে বৃষ্টি হয়েছে, তাও কয়েক ঘণ্টা ধরে। এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করার পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওই বরফচূড়ায় তাপমাত্রা বেড়ে হিমাঙ্কের ওপরে উঠে যাওয়ায় এমনটি ঘটেছে। একে আশীর্বাদ নয়, বরং অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডাটা সেন্টার জানায়, গত সপ্তাহে গ্রিনল্যান্ডের তিন হাজার ২১৬ মিটার উঁচু ওই বরফচূড়ার তাপমাত্রা ৯ ঘণ্টা ধরে হিমাঙ্কের ওপরে ছিল। সাধারণত এমন তাপমাত্রা সেখানে দেখা যায় না। তবে তিন দশকের কম সময়ের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা অন্তত তিনবার ঘটল। ১৪ থেকে ১৬ আগস্ট সেখানে সাত বিলিয়ন টন বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় গ্রিনল্যান্ডে, যা ১৯৫০ সালে তথ্য সংগ্রহ শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া ১৫ আগস্ট যে পরিমাণ বরফ গলেছে, তা আগস্টের মাঝামাঝিতে স্বাভাবিকের চেয়ে সাত গুণ বেশি।
বৃষ্টিপাতের জন্য তাপমাত্রা অবশ্যই শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে বা সামান্য কম হতে হয়, ফলে এ ঘটনা অ্যান্টার্কটিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বরফের রাজ্যে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার বৃদ্ধির প্রভাবের ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ উষ্ণ বায়ুর কারণেই এই তীব্র বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বৃষ্টিপাতের ফলে বরফে ঢাকা অঞ্চলটিতে প্রায় ৭০০ কোটি টন পানি নিঃসরণ হয়েছে।
ডেনমার্কের আবহাওয়া ইনস্টিটিউটের গবেষক মার্টিন স্টেন্ডেল এএফপিকে বলেন, ‘এটি একটি চরম ঘটনা, যা আগে কখনো ঘটেনি। সম্ভবত এটি বৈশ্বিক উষ্ণতার লক্ষণ। গত দুই হাজার বছরে গ্রিনল্যান্ডে বরফের চূড়ায় তাপমাত্রা ৯ বার হিমাঙ্কের উপরে উঠেছে। এর মধ্যে গত ১০ বছরে এ নিয়ে ৩ বার। কিন্তু আগে কখনোই বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেনি।’
গ্রিনল্যান্ডে অস্বাভাবিক গরম তাপমাত্রা দেখা গেছে। উত্তর গ্রিনল্যান্ডে এবারের গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর ফলে দ্বীপের বড় অংশে বরফ গলতে দেখা গেছে সে সময়।
জুলাইয়ের শেষদিকে গ্রিনল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি বরফ গলার ঘটনা ঘটে। সে সময় একদিনে যে পরিমাণ বরফ গলেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের পুরো ফ্লোরিডা রাজ্য দুই ইঞ্চি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বরফ গলার এই হার এবং গত সপ্তাহের বৃষ্টি— দুটোই ঘটেছে বায়ুপ্রাবাহের ধরনের কারণে, যার অর্থ হচ্ছে উষ্ণ এবং আর্দ্র বায়ু সাময়িকভাবে ঢেকে রেখেছিল গ্রিনল্যান্ডকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টারের বিজ্ঞানী টুইলা মুন বলেন, গ্রিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ চূড়ায় এই উদ্বেগজনক বৃষ্টি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তার মতে, বাড়তে থাকা বন্যা, অগ্নিকাণ্ড এবং অন্যান্য অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এটিও একটি সতর্কবার্তা, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস কমানোর প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই মানিয়ে নেওয়ার প্রতি মনোযোগী হতে হবে, একইসাথে ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকিও কমাতে হবে।
বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসৃষ্ট কারণে কার্বন নিঃসরণ বেড়ে চলায় পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এর প্রভাবে গলছে বরফ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ১৯৯৪ সাল থেকে গ্রিনল্যান্ডের কয়েক ট্রিলিয়ন টন বরফ গলে গিয়ে বেড়েছে সমুদ্রের উচ্চতা; ঝুঁকির মুখে ফেলেছে সারা বিশ্বের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি মানুষকে। এরই মধ্যে সমুদ্রের উচ্চতা ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং চলতি শতকের শেষ নাগাদ উচ্চতা বাড়তে পারে আরও ২৮ থেকে ১০০, এমনকি ২০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড বইয়ের তথ্যে এ বছরের জুলাই মাসটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। এমনটাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান এবং জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল ওশনিক অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)।
এর আগে, চলতি সপ্তাহেই জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব উত্তপ্তকারী বিপজ্জনক গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে সামুদ্রিক পানির উচ্চতা দুই মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
জাতিসংঘের মহাসচিব এটিকে ‘মানবতার জন্য লাল সংকেত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি এখনই সব শক্তি একত্রিত করি, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। প্রতিবেদন এটি পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, দেরি করার মতো সময় নেই আর কোনো অজুহাতেরও জায়গা নেই।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আগে ১০০ বছরে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হতো, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি ছয় থেকে নয় বছরে তা ঘটবে। এই শতাব্দীজুড়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জলস্তর বাড়বে, ভাঙন দেখা দেবে, অনেক শহর পানিতে তলিয়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্রিনল্যান্ডে বৃষ্টিপাত মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা। মানবগ্রহকে রক্ষায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখনই কমাতে হবে, হাতে একদিনও সময় নেই। না হলে বিপন্নতার মুখে পড়বে সভ্যতা।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৯
আপনার মতামত জানানঃ