তালিবানের দখলের পর থেকে গা শিউরে ওঠা অরাজকতার আশঙ্কায় দেশ ছাড়তে শুরু করেছে আফগান অভিবাসী ও নাগরিকরা। আফগানিস্তান দখলের সপ্তাহ পার না হতেই বেশ কিছু নৃশংসতাও দেখাতে শুরুর করেছে তালিবান। বর্তমান পরিস্থতিতে পুরুষদের থেকে নারীরা বেশি ভীত হয়ে আছেন। দ্য সান নামের ব্রিটিশ সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে আজ মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) তালিবান মৃত নারীদেরও ধর্ষণ করেছে বলে দাবি করেছেন আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক আফগান নারী পুলিশ সদস্য।
ওই নারী পুলিশ সদস্য নিজেকে মুসকান বলে পরিচয় দিয়েছেন। তার দাবি, তালিবান সদস্যরা ধর্ষণ করার সময় জীবিত বা মৃত কী না তা বাদ বিচার করত না। দীর্ঘ ২০ বছর পর তালিবান ফের ক্ষমতা দখল করলে ভয়ে ভারত পালিয়ে আসেন মুসকান।
তালিবানরা যে নারীদের ওপর বর্বর অমানুষিক অত্যাচার করেছে তার একের পর এক ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে ১৫ আগস্ট কাবুল দখল নেয়ার পর থেকে। কর্মক্ষেত্র থেকে নারীদের বিতাড়িত করা, পোশাক নিয়ে ফতোয়ার জেরে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা সে দেশে ঘটেই চলেছে। এমন সংকটকালে কাবুল থেকে দিল্লিতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন মুসকান। দিল্লি পৌঁছনোর পর একটি সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের চোখে দেখা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন তিনি। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশ তালিবানদের দখলে চলে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে হলে আর দেশে থাকা যাবে না।
ভারতের এক সংবাদমাধ্যমকে মুসকান জানান, তালিবান সদস্যরা নারীদের তুলে নিয়ে যেত; তাদের হত্যা করত। এমনকি তালিবান সদস্যদের মৃতদেহ ধর্ষণ করারও নজির আছে বলে দাবি করেছেন মুসকান। ওই গণমাধ্যমকে মুসকান জানান, সেখানে (আফগানিস্তানে) আমরা নানা রকম আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছি। আমাদের নানাভাবে হুমকি দেওয়া হত। সেখানকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে নারী কাজে যেতেন তিনি আর তার পরিবার ঝুঁকির মধ্যে থাকতেন।
নারীদের প্রতি তালিবান কতটা নৃশংস, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে মুসকান জানান, প্রতিটি বাড়ি থেকেই অন্তত একজন নারীকে তালিবানরা তুলে নিয়ে যায়। তাদের ধর্ষণ করে খুন করে তারা। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছে, যারা আবার মৃতদেহগুলোকে ধর্ষণ করে আনন্দ পায়। পরিবারের নারীরা যদি উপার্জন করেন, তাহলে তাদের তালিবানের হুমকির মুখে পড়তে হয়। প্রথম হুমকিতে কাজ না হলে আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেয় না তারা। প্রথম হুমকির পরও যদি সেই নারীকে বাড়ির বাইরে দেখা যায়, তখনই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়।
সম্প্রতি এমন এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, বাইরে বের হওয়া মধ্যবয়সী এক নারীকে মাথায় গুলি করে খুন করে এক তালিবান নেতা। শুধু নারীরা নন, তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না পুরুষরাও। ‘ইসলাম মতে’ পোশাক বা দাড়ি না রাখলে যুবকদের মার খেতে হচ্ছে তালিবানের হাতে।
এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে তালিবান নারীদের স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি বাইরে বের হওয়ার সময় নারীদের চেহারা দেখানো পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল।
তবে এবার নিজেদের রক্ষণশীল মনোভাব থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বলে দাবি করছে তালিবান। কাতারের দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক দপ্তরের উপপ্রধান আব্দুস সালাম হানাফি নারী চাকরিজীবীদের কর্মস্থলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এই আশ্বাসের পরও আফগানিস্তান ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি তালিবানের ভয়ে ছাত্রীদের রেকর্ড পুড়িয়ে দিয়েছেন আফগানিস্তানের একমাত্র মেয়েদের বোর্ডিং স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শাবানা বাসিজ-রাসিখ। তালিবান সদস্যরা যেন এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের খোঁজ না পায় তাই এসব রেকর্ড পুড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন শাবানা।
টুইটারে শাবানা ছাত্রীদের রেকর্ড পোড়ানোর ব্যাপারে লিখেছেন, আফগানিস্তানের একমাত্র মেয়েদের বোর্ডিং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি সব ছাত্রীর রেকর্ড পুড়িয়ে দিয়েছি। ছাত্রীদের মুছে ফেলতে নয়, তাদের ও তাদের পরিবারকে রক্ষা করতে।
অন্যদিকে, তালিবানের হাত থেকে বাঁচতে আফগান নারী ফুটবলারদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে থাকা নিজেদের অ্যাকাউন্ট ও পাবলিক পরিচয় মুছে ফেলার আর জার্সিসহ সব খেলার সরঞ্জাম পুড়িয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন আফগান নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক খালিদা পোপাল।
এদিকে আফগানিস্তানে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে তালিবানের বিরুদ্ধে। পঞ্জশির উপত্যকায় আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদের নেতৃত্বে তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে আফগান বিদ্রোহীরা। জেহাদিদের রুখে দিতে গঠন হয়েছে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’। ইতোমধ্যে পঞ্জশিরে যুদ্ধ খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ