পুলিশবাহিনীর সদস্যরা অনেকের বিরুদ্ধেই মাদক সেবন, বিক্রি ও মাদক দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসানোর অভিযোগ সাধারণ মানুষের। এসব অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে পুলিশের কার্যক্রম ও তাদেরই তদন্তের মধ্য দিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বিভাগীয় বিধিমালার আওতায় শাস্তির ব্যবস্থাও নিচ্ছে। তা সত্ত্বেও মাদক সংক্রান্ত নতুন নতুন ঘটনায় নাম জড়াচ্ছে পুলিশের। আইনপ্রয়োগের সঙ্গে জড়িত মূল বাহিনীটি যদি এভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা অসম্ভব। তাই বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, ছোটখাটো পদক্ষেপে সন্তুষ্ট না থেকে বরং সরকারের উচিত পুলিশের আমূল সংস্কারের কাজে হাত দেয়া।
পুলিশসূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মরত ৬৮ সদস্য ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়েছেন। এজন্য ৪৩ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন ১৮ জন। এর মধ্যে ১০ জনকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করে আদেশ জারি করা হয়েছে। বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন ২৫ জনের বিরুদ্ধে। এখন থেকে মাঝেমধ্যেই ডোপ টেস্ট করা হবে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিভাগীয় ব্যবস্থাগ্রহণ এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। কারণ মাদক সেবন, বিক্রি বা তা দিয়ে নিরপরাধকে ফাঁসানোর চেষ্টা কেবল দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা নিয়ম ভঙ্গই শুধু নয়, বরং এ কাজগুলো আলাদা করে ফৌজদারী অপরাধের আওতায় পড়ে। তাছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেও ফাঁক থাকে, এখানে অনেক প্রশ্ন আছে। সুতরাং কেবল বিভাগীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করে এই সংকটের সমাধান বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের আদালতে তুলতে হবে এবং বাহিনী হিসেবে পুলিশ কেন এগুলোর সমাধান করতে পারছে না, সেটাও খুঁজে বের করতে হবে।
জানা গেছে, শুধু মাদক সেবন নয়, মাদক বিক্রি ও নিরীহ লোককে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া এবং বেশি মাদক উদ্ধার করে কম দেখানোর মতো অপরাধেও ডিএমপির কিছু সদস্যের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের তদন্তে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, মাদক বিক্রিতে ১০ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মাদক দিয়ে ফাঁসাতে গিয়ে পুলিশের ১০ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া টাকার বিনিময়ে উদ্ধার করা মাদক কম দেখানোর অপরাধে চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২২ নভেম্বর ২০২০, রবিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডিএমপি সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুনীতি বাস্তবায়নে পুলিশ নিরলস কাজ করছে। এর ধারাবাহিকতায় মাদক সেবন ও এর কারবারে জড়িত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রবিবার পর্যন্ত ডোপ টেস্টে পজিটিভের সংখ্যা ৬৮ জনে দাঁড়িয়েছে। চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় তাদের সবার বিরুদ্ধেই একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ডোপ টেস্টে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে উপপরিদর্শক (এসআই) ৭ জন, সার্জেন্ট ১ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ৫ জন, নায়েক ৫ জন এবং কনস্টবল রয়েছেন ৫০ জন।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, মাদক সংশ্লিষ্টতায় শাস্তি দেয়ার আগে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। যারা নিজেদের শোধরায়নি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মহানগর পুলিশের মাদকাসক্ত কোনো সদস্য আমার কাছে এলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। ডিএমপির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে ডোপ টেস্ট করানো হচ্ছে। জানা গেছে, মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ সদর দফতর। এর অংশ হিসেবে দুই মাস আগে ডিএমপি সদস্যদের ডোপ টেস্ট শুরু হয়।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে নবসৃষ্ট ট্রাফিক মিরপুর বিভাগের উপ কমিশনারের কার্যালয় উদ্বোধন শেষে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ডোপ টেস্টে যাদের পজিটিভ এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে বাকিদের জন্য সুস্পষ্ট বার্তা যাবে যে, আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। এ উদ্যোগের ফলে অনেকে ভালো হয়েছে এবং এ রাস্তা থেকে ফিরে এসেছে।
তিনি আর বলেন, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা মাদক ব্যবসায়ীকে সহযোগিতা করছে, সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনোরকম শিথিলতা দেখানো হচ্ছে না। সাধারণ মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নেয়া হয়, ঠিক সেভাবেই মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ডিএমপি সদস্যদের মধ্যে মাদকাসক্ত হিসেবে সন্দেহভাজনদের তালিকা করে সিআইডির ল্যাবে তাদের রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ডোপ টেস্টে এখন পর্যন্ত মোট অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য সংখ্যা ৬৮ জন। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে ৪৩টি। বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন ২৫ জনের বিরুদ্ধে। সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি হয়েছে ১৮ জনের বিরুদ্ধে এবং বরখাস্তের চূড়ান্ত আদেশ জারি হয়েছে ১০ জনের বিরুদ্ধে।
তিনি আরও বলেন, মাদক সংক্রান্ত অন্যান্য অভিযোগ যেমন মাদক বিক্রি অভিযুক্ত ১০ জন, মাদক সেবনে অভিযুক্ত পাঁচজন, মাদক দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনায় অভিযুক্ত ১০ জন এবং উদ্ধার মাদক উদ্ধারের তুলনায় কম দেখিয়ে অর্থগ্রহণে অভিযুক্ত চারজন। মোট ২৯ জন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের মধ্যে মাদক সেবনে একজন এবং মাদক দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনায় পাঁচজনসহ মোট ছয়জন চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপি কমিশনারের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা (ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস ডিভিশন-এনআইডি) পুলিশের মাদক সেবন ও মাদক কারবারে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্ত করছে। ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের অনেকে মাদকাসক্ত হওয়ার পাশাপাশি মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে আর্থিক সুবিধা নেয় বলেও তদন্ত উঠে এসেছে। তাদেরও তালিকা করা হচ্ছে।
মিই/
আপনার মতামত জানানঃ