অনেক নারীই বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগে থাকেন। তবে শুধু নারীরাই নয়, পুরুষরাও এই সমস্যায় ভুগে থাকেন। বরং নারীর চেয়েও দেড় শতাংশ বেশি হারে পুরুষরা বন্ধ্যাত্বে ভোগেন। প্রথাগতভাবে সন্তান না হবার জন্য নারীকেই দায়ী করা হলেও এতে পুরুষ সঙ্গীর ভূমিকা উঠে আসছে ইদানিংকালে। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান এনএইচএসের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, যে দম্পতিদের সন্তান হয়না, তাদের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এর কারণ হচ্ছে স্বামীর শুক্রাণুর মান নিম্ন ও সংখ্যা কম হওয়া।
বন্ধ্যাত্বকে পুরুষত্বহীনতা ভেবে মেল ইগোর কারণে পুরুষেরা একদিকে চিকিৎসা করাতে গাফিলতি করেন, অন্যদিকে অবসাদ তৈরি হয়। চিকিৎসক জানান, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে কিছু কিছু মানুষ নিজের পৌরুষ সম্পর্কে নিজেই সন্দিহান হয়ে অবসাদে ভোগেন। পুরুষত্বহীনতা হলো স্বামী-স্ত্রীর যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষমতা। এর ডাক্তারি নাম সেক্সুয়াল ডিজফাংশন। অন্যদিকে পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ বীর্যে শুক্রাণুর পরিমাণ কম হওয়া।
চিকিৎসকদের মতে, প্রতি মিলিলিটারে শুক্রাণুর সংখ্যা ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটির কম হলেই প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী প্রতি মিলিলিটারে ১৫ মিলিয়নের বেশি শুক্রাণু থাকলেই তাকে স্বাভাবিক বলা হয়। এছাড়া যে দম্পতিরা সন্তান চাইছেন তাদের এক বছর চেষ্টার পরও গর্ভসঞ্চার না হলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলা হয়।
কতটা ভয়াবহ পুরুষের বন্ধ্যাত্ব
করোনাকালে ভারতের এক গবেষণায় জানা যায়, প্রতি ৬ জোড়া দম্পতির এক জোড়া সন্তানহীনতার শিকার। শহরাঞ্চলে বন্ধ্যাত্বের হার বেশি। আইএসএআর এর হিসেবে ২০১৯ সালে সে দেশে সন্তানহীন দম্পতির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৭৫ লক্ষ।
এদিকে, মেয়েরাই প্রধানত বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী এই ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে পুরুষদের মধ্যে সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, দাবি বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসকদের। সমীক্ষায় জানা যায়, মেয়েদের তুলনায় ১.৫% বেশি বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দেখা যাচ্ছে পুরুষদের মধ্যে।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে গত ৪০ বছর ধরেই পশ্চিমা দেশগুলোয় পুরুষদের শুক্রাণুর সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের পুরুষদের ওপর করা হয়েছিল এ গবেষণা।
বিশ্বজুড়ে পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের ওপর চালানো ২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, পৃথিবীতে দম্পতিদের প্রায় ১৫ শতাংশ বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তান না হবার জন্য শুধু পুরুষই দায়ী, আর সার্বিকভাবে বন্ধ্যাত্বের পেছনে পুরুষের ভুমিকা আছে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ।
এই জরিপে দেখা যায়, ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে পুরুষদের কারণে বন্ধ্যাত্বের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ এবং এশিয়া মহাদেশে এর পরিমাণ ৩৭ শতাংশ ।
কিন্তু গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে পুরুষদের বন্ধ্যাত্বের ব্যাপারে নির্ভুল পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। এর কারণ, নারীদের বন্ধ্যাত্ব নিযে যতটা আলোচনা হয়, নানা সামাজিক কারণে অনেক দেশেই পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না।
যে কারণে শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যায়
বিজ্ঞানীরা শুক্রাণুর পরিমাণ কমে যাওয়ার একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। তবে, এটাও মনে রাখতে হবে যে অনেক রোগীর ক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা কম হবার কারণ স্পষ্ট বোঝা যায় না।
বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে জীবনযাপন পদ্ধতি পর্যন্ত অনেক কিছুই শুক্রাণুর স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে জীবনযাপন পদ্ধতি পর্যন্ত অনেক কিছুই শুক্রাণুর স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিজ্ঞানীরা সাধারণভাবে যে কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেন এর মধ্যে প্রধান ক’টি এখানে উল্লেখ করা হলো।
- পুরুষের দেহে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, বা কম হরমোন উৎপাদন।
- ক্লাইনফেল্টার সিনড্রোম নামে এক ধরণের জেনেটিক সমস্যা।
- কোন কোন শিশুর জন্মের সময় অন্ডকোষ দেহের ভেতরেই রয়ে যায়। এটিও শুক্রাণুর সমস্যা ঘটাতে পারে।
- দেহের যে নালীগুলো অন্ডকোষ থেকে শুক্রাণু বহন করে নিয়ে যায় তা জন্ম থেকে অনুপস্থিত থাকা, বা কোন রোগ বা আঘাতজনিত কারণে নালীগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া।
- যৌনাঙ্গের কোন সংক্রমণ যেমন ক্ল্যামাইডিয়া, গনোরিয়া, বা প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের প্রদাহ।
- অন্ডকোষের শিরা বড় হয়ে যাওয়া বা ভ্যারিকোসিলস।
- অন্ডকোষে কোন অস্ত্রোপচার বা হার্নিয়ার অপারেশন।
- অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপান, গাঁজা এবং কোকেনের মত মাদক সেবন।
- অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়া বা স্থূলতা।
- কিছু কিছু ওষুধ, যেমন টেস্টোস্টেরন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, দীর্ঘকাল ধরে এ্যানাবোলিক স্টেরয়েড ব্যবহার, কেমোথেরাপির মত ক্যান্সারের ওষুধ, কিছু কিছু এ্যান্টিবায়োটিক বা বিষণ্ণতা কাটানোর ওষুধও শুক্রাণুর মান ও সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে।
শুক্রাণুর সংখ্যা ও স্বাস্থ্য যেভাবে বাড়াতে পারেন
বিজ্ঞানীরা বলেন, আপনার জীবনযাপনে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেও আপনি শুক্রাণুর সংখ্যা ও স্বাস্থ্য বাড়াতে পারেন; যাতে সন্তানের পিতা হবার সম্ভাবনা বাড়বে।
পুরুষদের অন্ডকোষ দেহের বাইরে ঝুলে থাকে, কারণ তাতে দেহের ভেতরের তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম উষ্ণ অবস্থায় সবচেয়ে ভালো মানের শুক্রাণু তৈরি হতে পারে।
সেকারণে একজন পুরুষ যদি দীর্ঘ সময় ধরে খুব গরম পরিবেশে কাজ করেন, তাহলে তার উচিত হবে নিয়মিত স্বল্প সময়ের বিরতি নেয়া। তাকে যদি দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকতে হয়, তাহলে তার নিয়মিত উঠে দাঁড়ানো এবং একটু হেঁটে আসা দরকার।
অতিরিক্ত টাইট অন্তর্বাস পরার ফলে অন্ডকোষের তাপমাত্রা অন্তত ১ ডিগ্রি বেড়ে যায় বলে মনে করা হয়। অবশ্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে চাপা অন্তর্বাসের কারণে শুক্রাণুর মানের ওপর তেমন কোন প্রভাব পড়ে না। তবে সন্তান নেবার পরিকল্পনা থাকলে আপনি অপেক্ষাকৃত ঢিলা আন্ডারওয়্যার পরতে পারেন।
সুষম খাদ্য খান, মদ ও সিগারেট ত্যাগ করুন। কারণ এগুলো পুরুষের শুক্রাণুর মান ও উর্বরতা কমিয়ে দেয়। সপ্তাহে ১৪ ইউনিটের বেশি মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
খাদ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিগুণে ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খাওয়া; যা শুক্রাণুর স্বাস্থ্য ভালো রাখবে। প্রতিদিন ভাত, আলু বা রুটির সাথে অন্তত পাঁচ রকম ফল ও সবজি, শিম, ডাল এবং দই খান। সাথে আরো খাবেন মাছ, ডিম ও মাংসের মত প্রোটিনজাতীয় খাদ্য।
পুরুষদের ওজন বেশি হলে তা শুক্রাণুর সংখ্যা ও মান কমিয়ে দিতে পারে। তাই নিজের বডি ম্যাস ইনডেক্স বা বিএমআই হিসাব করুন এবং তা ২৫-এর নিচে রাখুন।
বিএমআই হিসেব করা খুবই সহজ। আপনার ওজনকে (কিলোগ্রামে) আপনার উচ্চতার (মিটারে) বর্গ দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যাটা পাবেন, তাই হলো আপনার বিএমআই। এটা ২৫ এর বেশি হলেই আপনাকে ওজন কমানোর জন্য শরীরচর্চা এবং খাবারদাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সবশেষে মানসিক চাপমুক্ত থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপের কারণে যৌন ইচ্ছা কমে যেতে পারে, কমে যেতে পারে শুক্রাণু উৎপাদনও।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৭
আপনার মতামত জানানঃ