ইসরায়েলি ফোন-হ্যাকিং কোম্পানি সেলেব্রাইট বাংলাদেশে তাদের প্রযুক্তি বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা, সাধারণ মানুষকে নির্যাতন এবং গুম করার ক্ষেত্রে ইসরায়েলি এই কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিবেদন সামনে আসার পর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এ বছরেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম।
যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ এ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের তথ্য মতে, পৃথিবী জুড়ে সমালোচনার মুখে সেলেব্রাইট তার প্রযুক্তির ভবিষ্যত বিক্রির নৈতিকতা বিবেচনার জন্য একটি বিশেষ উপদেষ্টা কমিটি গঠনেরও অনুমতি দিয়েছে।
সেলেব্রাইট সারা পৃথিবী জুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘ডিজিটাল ফরেনসিক’ সুবিধা প্রদান করে থাকে। এই কোম্পনির মূল প্রযুক্তিটিকে বলা হয় দ্য ইউনিভার্সাল ফরেনসিক এক্সট্র্যাকশন ডিভাইস। এর দ্বারা যেকোনও লক করা মোবাইল ফোন থেকে মালিকের সম্মতি ছাড়াই তথ্য সংগ্রহ করা যায়। সেলেব্রাইটের প্রধান ক্রেতা পশ্চিমা পুলিশ ফোর্সগুলো; তবে এটা বিভিন্ন দেশেই তাদের এই প্রযুক্তি বিক্রি করে থাকে; এমনকি বাংলাদেশেও।
গত মার্চে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে মানবাধিকার সংস্থার এক আইনজীবী ইটায় ম্যাক বাংলাদেশের র্যাবের সাথে সেলেব্রাইটের ব্যবসায়িক সম্পর্ক তুলে ধরেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, র্যাব মানবধিকার সগঠনগুলোর কাছে ‘ডেথ স্কোয়াড’ নামে পরিচিত। পাশাপাশি র্যাব মুসলিম দেশে এলজিবিটি সমাজের উপর নিপীড়নের অভিযোগেও অভিযুক্ত। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে র্যাব ৪৬৬ টি বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে জড়িত। এ সত্ত্বেও কেন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেলেব্রাইটকে বাংলাদেশে তাদের পন্য বিক্রির অনুমতি দিল, তা জানতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে ম্যাকের করা আবেদনে এই সংক্রান্ত কাগজপত্র যুক্ত করা হয়েছে।
ম্যাকের জমা দে’য়া কাগজপত্রের সূত্র মতে, সেলেব্রাইট বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা করার জন্য সিঙ্গাপুর ভিত্তিক একটি কোম্পানিকে প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহার করেছে; যাদের ইসরায়েলের সাথে কোনও প্রকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং তারা ইসরায়েলের কোনও কোম্পানির সাথে সরাসরি ব্যবসায়ে যুক্ত হওয়ার অধিকার রাখে না। এমনকি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে র্যাবের কিছু কর্মকর্তা সিঙ্গাপুরে যান, সেলেব্রাইটের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নে’য়ার জন্য।
ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের শুরুতে কোম্পানিটি বাংলাদেশে তাদের বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই তথ্য জনসম্মুখে আসে গত মে মাসে; যখন সেলেব্রাইট সিকিউরিটিজ এ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে তাদের কাজের পূর্ণ বিবরণী জমা দেয় এবং কোন কোন দেশের সাথে তারা ব্যবসা করবে না- তার একটি তালিকা প্রকাশ করে। এবং এই আগস্ট মাসে তারা সিকিউরিটিজ এ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে বিক্রি বিষয়ে নৈতিক বিবেচনার জন্য তাদের পরিকল্পনার কথা জানায়।
যেখানে সেলেব্রাইট জানায়, আমরা তাদের কাছেই প্রযুক্তি বিক্রি করবো, যারা আইনের মধ্য থেকে কাজ করবে এবং মনবাধিকার বা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান জানাবে। আমরা বাংলাদেশ, বেলারুশ, চীন, হংকং, ম্যাকাও, রাশিয়া এবং ভেনিজুয়েলার সাথে মানবাধিকার এবং তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সেলেব্রাইট দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে তারা বৈধ আইন প্রয়োগকারী বাহিনীদের কাছেই তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করে আসছে। এমনকি মানবাধিকার সংস্থার বিধিলংঘনের অভিযোগ থাকায় তারা অনেকের দেশের প্রস্তাব প্রত্যাখানও করেছে।
তবে সমালোচকরা ইন্দোনেশিয়া, ভেনিজুয়েলা, সৌদি আরব এবং বেলারুশের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়া দেশগুলোতে সেলেব্রাইটের প্রযুক্তি বিক্রির কড়া নিন্দা জানিয়ে আসছে। বেশিরভাগ বিক্রির তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হবার পর তা বাতিল করা হয়েছে বলেও জানা যায়।
তবে এ ধরনের অভিযোগের বিপরীতে সেলেব্রাইট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য বা ইসরাইলি সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলোতে বা যারা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) কালো তালিকাভুক্ত, সেসব দেশগুলোতে সে পণ্য বিক্রি করে না।
সেলেব্রাইট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য বা ইসরাইলি সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলোতে বা যারা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) কালো তালিকাভুক্ত, সেসব দেশগুলোতে সে পণ্য বিক্রি করে না।
সেলেব্রাইট জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য বা ইসরাইলি সরকার কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দেশগুলোতে বা যারা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) কালো তালিকাভুক্ত, সেসব দেশগুলোতে সে পণ্য বিক্রি করে না।
সেলেব্রাইটের এক মুখপাত্র জানান, তাদের প্রযুক্তি বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু কঠোর ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনও দেশের সরকার সেলেব্রাইটের প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করবে তা নিয়ে কোম্পানিটির স্থান খুব স্পষ্ট এবং কঠোর। আন্তর্জাতিক প্যারামিটার মেনেই আমাদের প্রযুক্তি বিক্রি করা হয়; যেখানে ক্রেতা দেশটির মানবাধিকার রিপোর্ট পর্যালোচনা করা হয় এবং দুর্নীতি বিরোধী নীতি খুঁটিয়ে দেখা হয়।
সেলেব্রাইট একমাত্র ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান নয়, যারা বাংলাদেশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত আল জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসরায়েলের সাইবার-নজরদারি প্রতিষ্ঠান পিকসিক্স বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে তাদের ‘প্যাসিভ সেল ফোন মনিটরিং এ্যন্ড ইন্টারসেপশন’ সিস্টেম বিক্রি করেছে।
এনএসও গ্রুপ এবং তাদের পেগাসাস স্পাইওয়ারের উপর আন্তর্জাতিক তদন্তে ইসরায়েলি প্রযুক্তির অপব্যবহার বিশ্ব জুড়ে সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে। তদন্তে জানা যায় এনএসও’র ক্লায়েন্টদের দ্বারা সারা পৃথিবীতে ১৮০ জন সাংবাদিককে সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসেব ধরা হয়েছে। এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া ১৫ টিরও বেশি সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে ইসরায়েলের সংবাদ মাধ্যম হারিজ এটি প্রকাশ করতে সাহায্য করেছিল যে ফরবিডেন স্টোরিজ নামে একটি অলাভজনক সংগঠনের নেতৃত্বে কীভাবে আক্রমণাত্মক ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার বিক্রি মুসলিম রাষ্ট্রসহ শত্রু দেশগুলোর কাছে ইসরাইলকে পৌঁছতে ভূমিকা রেখেছিল।
বাংলাদেশেরও নাম উঠে আসে এই তদন্তে। এই লিস্টে বাংলাদেশিদেরও ফোন নাম্বার পাওয়া যায়; তবে ক্লায়েন্ট কে এটা জানা যায়নি বা এনএসও দক্ষিণ এশিয়ায় আদৌ কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা সে বিষয়েও কিছু জানা যায়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭২৮
আপনার মতামত জানানঃ