মোবাইল ও সামাজিক মাধ্যমে আড়িপাতার ইসরায়েলি আধুনিক সরঞ্জাম কিনেছে, এমন খবর আলোচনার মধ্যেই আইনসম্মতভাবে নজরদারি বা আড়িপাতার জন্য বাংলাদেশে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে বহু বছর ধরেই মোবাইল ফোন ও সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক ঘটনায় মোবাইলের কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও।
দেশটির রাজনৈতিক ও অ্যাকটিভিস্টরা বলছেন, এভাবে আড়িপাতার কারণে তাদের মধ্যে উদ্বেগ এবং বাড়তি চাপ তৈরি করছে। বিরোধী রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন, বিরোধীদের দমন করার যন্ত্র আড়িপাতার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে সরকার।
সরকারের বক্তব্য
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার (১২ই জানুয়ারি ২০২৩) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে ‘আইনসম্মতভাবে’ আড়িপাতার ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
একজন সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘’ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকার বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইনসম্মতভাবে মোবাইল ও ইন্টারনেট মাধ্যমে আড়িপাতার ব্যবস্থা) চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।‘’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুদিন আগে আনুষ্ঠানিক এই স্বীকারোক্তি দিলেও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বহুদিন ধরেই এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু মোবাইল নয়, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এসব সংস্থা নজরদারি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ অনেক পুরনো
এর আগে ২০২১ সালে, কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায় এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ইসরায়েল থেকে একই ধরনের নজরদারী প্রযুক্তি কেনার বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়।
ভয়েস অব আমেরিকাকে ২০২১ সালের অগাস্টে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে এনটিএমসির প্রধান, মেজর জেনারেল (তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) জিয়াউল আহসান বলেছিলেন, তার প্রতিষ্ঠান দেশের স্বার্থে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে।
এনটিএমসি মূলত একটি প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক নির্দেশিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থা তাদের অপারেশনাল কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য এনটিএমসি থেকে কারিগরি সহায়তা নিয়ে থাকে। প্রত্যেক সংস্থাই আলাদা আলাদাভাবে এই সহায়তা নিয়ে থাকে। এখানে, কোন সংস্থা কার ফোন রেকর্ড করছে এনটিএমসির জানার কোনও সুযোগ নেই।
মোবাইল কল রেকর্ড ফাঁস
ফোনালাপে আড়িপাতা বন্ধ করতে ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন ১০ জন আইনজীবী। সেই রিটে ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৬টি আড়িপাতার ঘটনার উল্লেখ করা হয়। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার টেলিফোন আলাপও ছিল।
বাংলাদেশ কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পরে নুরুল হকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়।
সেই ঘটনায় নুরুল হক বলেছিলেন, আমরা যেহেতু অপজিশনের জায়গা থেকে রাজনীতি করি তাই আমার কাছে একাধিকবার মনে হয়েছে যে আমার ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে। কারণ আমার কিছু ব্যক্তিগত আলাপ-আমি বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি যে এগুলোর তথ্য বাইরে প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। এটাতো সাধারণ মানুষের কাজ না।
বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং অন্য আরেক ব্যক্তির সাথে মাহমুদুর রহমান মান্নার একটি কথিত টেলিফোন আলাপ ২০১৬ সালে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পরার পর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এক বছর আট মাস কারাগারে থাকার পর রাষ্ট্রদ্রোহ এবং সেনা বিদ্রোহে উস্কানি দেবার মামলায় তিনি জামিন পান।
সর্বশেষ একজন চিত্রনায়িকার সঙ্গে অশালীন আলাপের অডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে মোহাম্মদ মুরাদ হাসানকে পদত্যাগ করতে হয়।
আড়িপাতার পেছনে দায় কাদের
এসব টেলিফোন আলাপ রেকর্ড বা ফাঁসের ঘটনায় অবশ্য কখনোই সরকারি তরফ থেকে দায়দায়িত্ব স্বীকার করা হয়নি। বরং একাধিক ঘটনায় ফোনালাপ ফাঁসের তদন্ত করার কথা জানিয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো।
কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিকদের অভিযোগ, এ ধরনের রেকর্ড ও ফাঁস করার মতো সক্ষমতা সরকারি সংস্থাগুলো ছাড়া অন্য কারও নেই।
তবে এনটিএমসি প্রধান জিয়াউল আহসান ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, ফোনালাপ কোনও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ফাঁস হয় বলে আমি মনে করি না। যেমন, ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ ফাঁসের ব্যাপারে যদি বলি, আপনারা জানেন, ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষ যার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার মোবাইলে কল রেকর্ডার অ্যাপ ইন্সটল করা ছিল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই কলটি রেকর্ড হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে কেউ সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়। এভাবেই দুই পক্ষের কোনও একজনের অসাবধানতা বা কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব ফোনালাপ ফাঁস করে থাকে বলে আমি মনে করি।
আড়িপাতা নিয়ে উদ্বেগ
বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক এবং অ্যাকটিভিস্টরা বলছেন, টেলিফোন ও সামাজিক মাধ্যমে আড়িপাতা এবং একের পর পর ফাঁসের ঘটনা তাদের মধ্যে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে। এখন এমনকি স্বজনদের সাথে স্বাভাবিক টেলিফোন আলাপেও তারা স্বস্তি বোধ করেন না।
রাজনৈতিক নেতা বা মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা এখন সাধারণ টেলিফোন লাইনে কথা বলতে আগ্রহী হন না। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে তারা কথা বলেন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী নূর খান লিটন বলছেন, ‘’এভাবে আড়িপাতাকে আমাদের কাজের জন্য, মানবাধিকারের জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে আমরা মনে করি। কারণ যারা সরকারি নিপীড়ন বা বঞ্চনার শিকার হয়েই আমাদের কাছে আসেন। তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ করতে হয়। কিন্তু এজেন্সিগুলো সেখানে আড়িপেতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে। তারা এমন সব কাজ করে, যাতে মানুষ তখন কথা বলতে ভয় পায়।‘’
তিনি বলছেন, মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই এভাবে আড়িপাতার বিরুদ্ধে কথা বলে আসছে।
তার অভিযোগ, মানুষের ব্যক্তি জীবনে টেলিফোন আলাপে আড়িপাতা হচ্ছে তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নজরদারি করা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সংস্থাগুলো এভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ছে, তাদের কথা ফাঁস করে বিব্রত করছে।
‘’কিন্তু এখন সংসদে মন্ত্রী নিজেই যেখানে এটা স্বীকার করে বিবৃতি দিচ্ছেন।, তার মানে এটাকে এখন প্রাতিষ্ঠানিক করা হচ্ছে। মানুষের ভিতরে ভয় ধরিয়ে দেয়ার এবং মানুষ যাতে কথা না বলে, সেটাই পাকাপোক্তভাবে করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”
বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদের সঙ্গেও কথা হচ্ছিল হোয়াটসঅ্যাপে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’মোবাইলে বা টেলিফোনে কথাবার্তা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, সংবিধানে আমাকে সেই অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও যখন আড়িপাতা হয়, তখন তো আমার গোপনীয়তার অধিকার রইল না। অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন তো মোবাইলে কারও সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারি না। এটা তো যেকোনো নাগরিকের জন্যই একটা উদ্বেগের ব্যাপার।‘’
‘’আর আমার মনে হয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমন করার জন্য এসব প্রযুক্তি আনা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বহুদিন ধরেই দেখা গেছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের টেলিফোন আলাপই ফাঁস হয়, সরকারি লোকজনের কথা কিন্তু ফাঁস হতে দেখা যায় না।‘’
তিনি বলছেন, একাধিক ফাঁসের ঘটনার কারণে এখন যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন অ্যাপস নামিয়ে কথা বলেন।
‘’কিন্তু সেখানেও শুনি, তারা নাকি এগুলোতেও আড়ি পাততে পারে। কিন্তু কি করবো, এমনি টেলিফোনের চেয়েও কিছু হয়তো নিরাপদ।‘’
এসডব্লিউএসএস/১০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ