গত মাসে ভয়াবহ বন্যার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে চীন। দেশটির হুবেই প্রদেশে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে দেখা দিয়েছে বন্যা। এতে সেখানে অন্তত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেশী প্রদেশে এক হাজার বছরের মধ্যে ভয়াবহতম বন্যায় কয়েক শ প্রাণহানির মাস পেরোতেই নতুন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশটি। খবর দ্য গার্ডিয়ান, এএফপি
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে জানানো হয়, বন্যা, ভূমিধস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার মধ্যেই প্রায় ছয় হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারো বাড়িঘর।
হুবেইয়ের জরুরি সেবা ব্যুরো শুক্রবার জানায়, বৃহস্পতিবার ইচেং শহরে রেকর্ড ৪৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। প্রদেশের বিভিন্ন বাঁধে পানির উচ্চতা বিপৎসীমার ওপরে।
বন্যা-ভূমিধসে কমপক্ষে চারজন নিখোঁজ বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া।
হুবেই প্রদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো জানিয়েছে, প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে প্রদেশটিতে ভূমিধস দেখা দিয়েছে। ধসে পড়েছে শত শত বাড়িঘর। হতাহতের ঝুঁকি এড়াতে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৬ হাজার বাসিন্দাকে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে প্রদেশটির নানা অঞ্চল।
চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার খবরে বলা হয়, গত বুধবার থেকে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও ৪ জন নিখোঁজ রয়েছে।
বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রদেশটির ইচেং শহরে বন্যার পানি প্রায় কোমরসমান উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে কোমর সমান পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে অনেক পরিবার। বুলডোজার দিয়ে অনেক মানুষকে উদ্ধার করেছে প্রশাসন।
চীনের কেন্দ্রীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করছে হাজারও ফায়ার সার্ভিসকর্মী, পুলিশ ও সেনা সদস্য।
গত ২০-৩০ বছরের মধ্যে এমন বৃষ্টিপাত দেখেননি বলে উল্লেখ করেন হুবেই প্রদেশের সুইঝৌ শহরের এক বাসিন্দা। স্থানীয় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের ফলে গতকাল পানির উচ্চতা প্রায় দুই থেকে তিন মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার প্রতিবেশীর বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।’
এর আগে গত মাসে দেশটির হেনান প্রদেশে মাত্র তিন দিনে এক বছরের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ওই সময়ে সৃষ্ট বন্যায় মৃত্যু হয় ৩০০ জনের বেশি মানুষের। গত সপ্তাহে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিচুয়ান প্রদেশে অতিবৃষ্টির ফলে বেশ কয়েকটি এলাকায় ভূমিধসে গৃহহীন হয় প্রায় এক লাখ মানুষ।
চীনের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, সাংহাইসহ ইয়াংসি নদীর উপকূলবর্তী বন্যাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে আরও এক সপ্তাহ বৃষ্টি হতে পারে।
চীন ছাড়াও সম্প্রতি বিরূপ আবহাওয়ার সাক্ষী হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল। ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চল, এশিয়ার ভারত, আফগানিস্তান, আফ্রিকার নাইজারে বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দাবদাহ ও দাবানলে বিপর্যস্ত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ।
অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরাসহ সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতাকে দায়ী করেছেন পরিবেশবিদরা।
ধ্রুব সত্য হচ্ছে, চীনের নির্গমন অন্য উন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত নির্গমনের চেয়ে বেশি। চীন যদি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে সক্ষম না হয়, তাহলে বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসবে না। এ ব্যাপারে চীনকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।
এদিকে সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (সিআরইএ) ২০ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। যা গত তিন মাসের চেয়ে ১৪.৫ শতাংশ বেড়েছে।
সিআরইএর প্রধান বিশ্লেষক লাউরি মাইলিভির্তা বলেছেন, ‘এটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বৃদ্ধির দ্রুততম হার। চীনের নির্মাণ কার্যকলাপের ফলে কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রথম ত্রৈমাসিকে নির্গমন বৃদ্ধির প্রায় ৭০ শতাংশ। বাকিগুলি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে।’
প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, চীন প্রায় ১২ বিলিয়ন মেট্রিক টন সিও২ উৎপন্ন করেছে, যা রেকর্ড গড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ও সিমেন্ট উৎপাদন থেকে দেশের সিও২ নিঃসরণ আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৪.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা আরও বলেন, ‘যদি সিও২ ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত বর্তমান হারে বাড়তে থাকে, তাহলে ২০২২-২০২৫ সালের মধ্যে আরও নিঃসরণ বাড়তে থাকবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হলো, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
তারা বলেছেন, আমাদের এই পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার একটি প্রধান কারণ হলো জীবাশ্ম গ্যাস, যাকে আমরা বলি গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট। বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন ও মিথেনসহ অন্যান্য গ্যাস এত বেশি বেড়ে গেছে যে, গত দেড় লাখ বছরের চেয়েও তা অনেক বেশি। আমাদের স্বীকার করতে হবে, এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা।
তারা আরও বলেন, এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাধ্যমেই বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের দুই-তৃতীয়াংশ নিঃসরিত হয়। দিনে দিনে এই পরিমাণ আরও বাড়ছে। ধ্রুব সত্য হচ্ছে, চীনের নির্গমন অন্য উন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত নির্গমনের চেয়ে বেশি। চীন যদি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে সক্ষম না হয়, তাহলে বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপই কাজে আসবে না। এ ব্যাপারে চীনকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ