মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পর থেকেই চরম অস্থীতিশীল হয়ে পড়েছে আফগানিস্তান। দেশটিতে বর্তমানে তীব্র লড়াই চলছে আফগান সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী তালিবানের মধ্যে। দ্রুত রাজধানী কাবুলের দিকে এগোচ্ছে তালিবান৷ এক সপ্তাহেই দেশটির বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক রাজধানীর পতন ঘটেছে৷ এরই মধ্যে দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ৯টিই তালিবানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সংঘর্ষ থেকে বাঁচতে রাজধানীতে পালাচ্ছেন অনেকে৷ ভিটেমাটি থেকে অনেকেই এক কাপড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন৷ পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেকে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় পেছনে ফেলে এসেছেন৷
তালিবান যোদ্ধাদের হাতে একের পর এক আফগানিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানীর পতন হচ্ছে। সেখানে ভয় ও আতঙ্কে লুকিয়ে সময় কাটাচ্ছেন নারীরা। দেশটির এক তরুণ নারী সাংবাদিক (২২) বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার এ আতঙ্কের বর্ণনা দিয়েছেন। দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে নাম প্রকাশ না শর্তে ২২ বছর বয়সী ওই নারী সাংবাদিক জানান, গত সপ্তাহে তার বাড়িতে তালিবান যোদ্ধারা তাকে খুঁজতে যান। বিষয়টি টের পেয়ে ওই তরুণী বোরকা পরে পালিয়ে যান।
তালিবানের ভয়ে নিজের নাম প্রকাশ করেননি ওই সাংবাদিক। এমনকি ভয়ে নিজের শহরের নামও জানাননি তিনি।
ওই নারী সাংবাদিক জানান, আমার পালিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু আমাদের পুরো প্রদেশ তালিবান দখল করে নেয়। শুধু বিমানবন্দরই সরকারি বাহিনীর দখলে আছে। যেহেতু আমার বয়স ২২ বছর আর তালিবান তরুণীদের জোর করে তাদের যোদ্ধাদের সাথে বিয়ে দিচ্ছে তাই আমি এমনিতেও সেখানে নিরাপদ ছিলাম না। তাছাড়া আমি একজন নবীন সাংবাদিক। তালিবান আমার সব সহকর্মীদেরও খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই আমি পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
প্রথমে তিনি তার মামার সাথে তাদের গ্রামে পালিয়ে যান। কিন্তু ওই সাংবাদিক গোপন খবরে জানতে পারেন, তালিবান তার ওই গ্রামে পালানোর খবর টের গেছে এবং সেখানে এসে তাদের প্রত্যেকের শিরচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করছে। এরপর ওই সাংবাদিক আর তার মামা আবার সেখান থেকে আরও দূরে পালিয়ে যান।
টেলিফোনের লাইনগুলো সব ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ওই তরুণীর সাথে তার বাবা-মার কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
ওই নারী সাংবাদিক তার পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, ‘দুই দিন আগে তালিবান সদস্যরা আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে আমাদের শহর দখল করলে জীবন বাঁচাতে আমাকে বাড়ি থেকে পালাতে হয়। আমি এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং আমার যাওয়ার কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।’
‘দুই দিন আগে তালিবান সদস্যরা আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে আমাদের শহর দখল করলে জীবন বাঁচাতে আমাকে বাড়ি থেকে পালাতে হয়। আমি এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং আমার যাওয়ার কোনো নিরাপদ জায়গা নেই।’
ওই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘গত সপ্তাহ পর্যন্ত আমি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। আজ আমি নিজের নামে লিখতে পারি না বা বলতে পারি না আমি কোথাকার বা আমার অবস্থান কোথায়। আমার পুরো জীবন মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আমি খুব ভয় পেয়েছি এবং আমি জানি না আমার কী হবে। আমি কি কখনো বাড়ি ফিরতে পারব? মা-বাবাকে আবার দেখতে পাব? আমি কোথায় যাব? যাওয়া-আসার প্রধান সড়ক উভয় দিক থেকেই বন্ধ। আমি কীভাবে টিকে থাকব?’
বাড়ি ছাড়ার ঘটনা বর্ণনা করে ওই সাংবাদিক বলেন, ‘তালিবান যাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে, তাদের ইতিমধ্যে খোঁজ করা শুরু করেছে। গত সপ্তাহ শেষে আমার ব্যবস্থাপক আমাকে ফোন করে বলেছেন যেন অপরিচিত কারও ফোনকলের উত্তর না দিই। তিনি বলেছেন, নারী সাংবাদিক বলে যেন লুকিয়ে থাকি। পারলে শহর ছেড়ে যেন চলে যাই।
আমি যখন পালানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখনই গোলাগুলি ও রকেট হামলার শব্দ শুনেছি। বিমান ও হেলিকপ্টার অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। আমার বাড়ির বাইরের রাস্তার ওপরেই লড়াই চলছিল। আমার চাচা আমাকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিলে আমি দ্রুত বোরকা পরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আমার মা-বাবা শহর ছাড়েননি। শহর ছাড়ার রাস্তা দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে তারা দ্রুত আমাকে পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। তখন রকেট হামলা তীব্র হতে শুরু করে। আমি মা-বাবাকে রেখেই চাচার সঙ্গে শহর ছাড়ি। এখন ওই শহরে আর মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে না বলে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে।’
ওই সাংবাদিক আরও বলেন, ‘বাড়ির বাইরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চোখে পড়ে। আমার আশপাশে বাড়ি ছাড়া তরুণীদের মধ্যে আমার পরে আর তেমন কেউ ছিল না। বাড়ির বাইরে রাস্তার ওপর তালিবান যোদ্ধাদের দেখা যাচ্ছিল। তারা ছিল সবখানেই। তবে আমি বোরকা পরে ছিলাম, তবু আমাকে চিনে ফেলতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম। আমি হাঁটার সময় ভয় পাচ্ছিলাম, তবে ভয়ের চিহ্ন দেখাতে চাচ্ছিলাম না।
ওই নারী সাংবাদিক বলেন, ‘আমার জানাশোনা অনেক তরুণী ও কিশোরী শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করছেন। আমি আমার বন্ধু, প্রতিবেশী, সহপাঠী, আফগানিস্তানের সব নারীর কথা ভাবছি। আমার সব নারী সহকর্মী ভীত।
‘আমার জানাশোনা অনেক তরুণী ও কিশোরী শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করছেন। আমি আমার বন্ধু, প্রতিবেশী, সহপাঠী, আফগানিস্তানের সব নারীর কথা ভাবছি। আমার সব নারী সহকর্মী ভীত।
অধিকাংশই শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অনেকেই প্রদেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে। আমরা সাংবাদিকতার মাধ্যমে তালিবানের বিরুদ্ধে বলেছি এবং তাদের রাগিয়ে দিয়েছি। এ মুহূর্তে সবকিছু নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আমি যা করতে পারি তা হলো পালিয়ে বেড়ানো এবং প্রদেশের বাইরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে বের করা। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
এদিকে, কয়েকদিন আগেই আফগানিস্তানে বোরকা না পরায় এক তরুণীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
এর আগে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর এক বিজ্ঞপ্তিতে নারীরা বাড়ি থেকে পুরুষ অভিভাবক ছাড়া একা বের হতে পারবেন না আর পুরুষদেরও লম্বা দাড়ি রাখতেই হবে বলে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে তাকহার প্রদেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তালিবান। এমনকি নারীদের বিয়ের জন্য পণ প্রথাও ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল সংগঠনটি।
এমনকি তালিবান সদস্যদের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় ইমামদের কাছে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী অবিবাহিত ও বিধবা নারীদের তালিকা চেয়েছে তালিবান।
এসব ঘটনা আফগানিস্তানে ৯০ দশকের তালিবান শাসন ব্যবস্থার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা ছিল তালিবানের হাতে। সে সময় চুরির জন্য হাত কেটে দেওয়া হতো, পাথর নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা করা হতো, এমনকি নারীদের ওপর ছিল নানা রকম বিধিনিষেধ।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা মোতায়েন হওয়ার আগে এসব আইন জারি করেছিল তালিবান। তখন দেশটিতে নারীদের চাকরি তো দূরের কথা, কোনো পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাইরে বের হওয়াও নিষেধ ছিল। এমনকি এই নিয়ম না মানলে কঠোর শাস্তিও ভোগ করতে হতো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ